প্রবাসী বাংলাদেশিদের কারণে কী বিশ্বের অন্যান্য ১৮০ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে?

  28-03-2020 04:21PM

পিএনএস(এম এম শাহীন) : নির্মমতা নয়, প্রবাসীদের প্রতি সদয় হোন

দেশের যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সবার আগে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন প্রবাসীরা। নানা প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করলেও তাদের মনপ্রাণ সর্বদা পড়ে থাকে দেশের মাটিতে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাদের হৃদয়ের টান অগাধ ও অকৃত্রিম। বাংলাদেশের যেকোনো সাফল্যে তারা যেমন গর্ব করেন, তেমনি যেকোনো বিপদ-আপদে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। প্রবাসীরা দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তাদের ঘাম আর শ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা চলমান থাকে। প্রবাসীরা দেশের একেকজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

প্রবাসীরা সব সময় দেশের ক্রান্তিলগ্নে মানুষের পাশে দাঁড়ান। তারা শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, রাস্তাঘাট, মসজিদ, মক্তবসহ নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নিরলসভাবে অবদান রেখে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশে রেখে যাওয়া পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গরিব-দুঃখী মানুষকে সব সময় তারা সাহায্য-সহযোগিতা করে আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

কিন্তু প্রবাসীরা দেশবাসীর কাছে এসবের বিনিময় প্রত্যাশা করেন না। তারা কেবল চান দেশবাসীর ভালোবাসা। তাই বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মাতৃভূমিতে বেড়াতে এসে বিমানবন্দরের ঝক্কি-ঝামেলা, ট্রাফিক জ্যামের দখল আর নানা বিড়ম্বনা পোহালেও স্বজন ও দেশবাসীকে কাছে পেয়ে এসব ভুলে যান। দেশের মানুষও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রবাসীদের কাছে টেনে নেন। বিদেশে উন্নত জীবনযাপন করলেও নাড়ির টানে তাই বারবার তারা ফিরে আসেন।

কিন্তু এবার যারা প্রবাস থেকে দেশে এসেছেন, তাদের এক ভয়াবহ তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ তাদের আগমনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। বুকে টেনে নেওয়া দূরে থাক, দূরদূর করে তাড়াতে পারলেই যেন তারা বাঁচেন। যে প্রবাসীরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন নায়ক, আজ তারা পরিণত হয়েছেন খলনায়কে। এর কারণ বিশ্বব্যাপী ভয়াল থাবা নিয়ে আবির্ভূত হওয়া ঘাতক করোনাভাইরাস।

অনেকের ধারণা, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আসা প্রবাসীদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এ কারণে দেশের কিছু মানুষ এবং প্রশাসনের অতিউৎসাহী কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রবাসীদের সঙ্গে নির্দয় ও অমানবিক আচরণ করছেন। প্রবাসীদের দেখলেই তারা আঁতকে উঠছেন। পরীক্ষা না করেই কোয়ারেন্টাইনে নেওয়ার নাম করে প্রশাসন তাদের নাজেহাল করছে। অনেক প্রবাসীর বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিকভাবে হেয় করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবাসফেরত বাংলাদেশিরাই কি করোনাভাইরাস বহন করেছেন। করোনাভাইরাস কি কেবল বাংলাদেশেই সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা কী এই সংক্রমণ বিশ্বের অন্যান্য ১৮০ দেশে বহন করেছেন ??? আমরা জানি, বিশ্বের প্রায় ১৮০টি দেশে করোনা তার ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে। চীনে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাসে ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে প্রায় ৫ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ২২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন ও চীনে করোনায় হাজার হাজার লোক মারা গেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। গোটা পৃথিবীর মানুষ একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের প্রবাসী নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এবং যারা দেশে ফিরতে ইচ্ছুক, তাদের ফিরিয়ে আনছে। তারা একে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করে কাউকে দোষারোপ না করে জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টো চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে।

ফেসবুকে একজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আগে সাউথ আফ্রিকার মদের বারের দরজায় লেখা ছিল “DOGS AND INDIANS ARE NOT ALLOWED” আর আজ আমার স্বাধীন বাংলার নামকরা মিষ্টির দোকান ফুলকলির দরজায় বড় করে লেখা ‘প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ’। এই স্ট্যাটাস দেখে অপমান আর ক্ষোভে সারা বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশিদের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আরেকজন লিখেছেন, এই করোনাভাইরাস এসে প্রমাণ করিয়ে দিল, প্রবাসীদের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা কতটুকু।আরেকজন লিখেছেন প্রতিটি প্রবাসীর বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিন ইত্যাদি ইত্যাদি।সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি প্রবাসীর পিঠে লাল ছোপ ছোপ দাগ ? এমনকি গুনতে হচ্ছে লক্ষ টাকা জরিমানা ???

যতটুকু জানি, দেশে ফিরে অধিকাংশ প্রবাসীই স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইন শর্ত মেনে চলছেন। তবে কিছুসংখ্যক প্রবাসী কোয়ারেন্টাইন আইন না মেনে নিজেদের মতো চলার অভিযোগও রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু প্রবাসীর অবিবেচনাপ্রসূত কাজের জন্য কি ঢালাওভাবে সবাইকে দায়ী করা উচিত।
২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিন সারা দেশ লকডাউন ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। এর মানে হলো যে যেখানে আছে, সেখানেই অবস্থান করবে। কিন্তু ২৪ ও ২৫ মার্চ আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য ও উদ্বেগজনক। এই দুই দিনে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য

বাসস্ট্যান্ডগুলোতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। এ যেন ঈদের ছুটি। ঢাকা হয়ে গেছে ফাঁকা। যেসব লোক প্রবাসীদের দেশে আগমনের চরম সমালোচনা করেছিল, ‘করোনার ছুটি’ পেয়ে তাদের অধিকাংশই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় প্রবাসীরা দেশে এসে যদি অন্যায় করে থাকেন, তাহলে ঢাকা ছেড়ে যারা গ্রামের বাড়িতে গেছেন, তারা কি অন্যায় করেননি?
প্রবাসীরা বাংলাদেশের অহংকার, গর্ব ও রত্ন।তাই সবার প্রতি অনুরোধ, প্রবাসীদের প্রতি নির্মমতা নয়, সদয় হোন। আসুন, বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত এই মহামারির হাত থেকে বাঁচতে জাতি হিসেবে আমরা এক হয়ে এই দুর্যোগকে মোকাবিলা করি।

লেখক : এম এম শাহীন সাবেক সাংসদ সদস্য। ফেসবুক থেকে নেওয়া।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন