১১ দফা দাবিতে থেমে পড়ল ক্রিকেট

  22-10-2019 12:32PM


পিএনএস ডেস্ক: তখন একাডেমির বালাই ছিল না। মিনহাজুল আবেদীনের নেতৃত্বে একঝাঁক ক্রিকেটার দাঁড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারির সামনে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ‘বিদ্রোহে’র ওটা ছিল প্রথম ঘটনা। টাইমলাইন হিসাব করলে ঠিক ২০ বছর পর আবারও বিদ্রোহ ক্রিকেটারদের। এবার বিপ্লবের মশাল হাতে সাকিব আল হাসান দাঁড়িয়েছেন মিরপুরে বিসিবির হোম অব ক্রিকেটের একাডেমি মাঠে। কাকতালীয়ভাবে দুটি আন্দোলনের ব্যাকগ্রাউন্ডে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট। সেবার কয়েক দিন পরই দেশে এসেছিল মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। আর এবার হুমকির মুখে ভারতের মাটিতে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফর।

১৯৯৯ টু ২০১৯; সময়ের ব্যবধানে একাডেমি হয়েছে এখন, অঙ্কের হিসাবে টাকা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সুবাদে অর্থাগমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে—এমন দাবি সরাসরি ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ছাড়া বাইরের কেউ করেন না। আর ক্রিকেটারদের অভিযোগের শেষ নেই। গতকালের ১১ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিবদের দূরে সরে যাওয়ার ঘোষণা সেসব অভিযোগের ভিত্তিতেই।

ভরদুপুরে মিডিয়ায় তোলপাড়—ক্রিকেটাররা সংবাদ সম্মেলন করবেন দুপুর ১টায়। আকস্মিক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য রটে যায় যে এত দিন যেসব অভিযোগ তাঁদের ড্রেসিংরুমের চার দেয়ালে বন্দি ছিল, সেসব নিয়েই সামনে আসছেন ক্রিকেটাররা। সর্বাগ্রে বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব স্বয়ং। সঙ্গে জাতীয় দল তো বটেই, একমাত্র বয়সভিত্তিক দলের ক্রিকেটার ও মহিলা ক্রিকেটার বাদে সবাই একই ছায়াতলে। তবে এই ক্রিকেটীয় আন্দোলনে কেন ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা নেই—সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। সংবাদ সম্মেলনের পর কোনো প্রশ্নই যে নেননি সাকিব কিংবা অন্য কেউ।

সংখ্যায় তাঁরা জনা পঞ্চাশেক। তবে প্রতিনিধিত্বের স্তর আর দাবিনামায় এটা পরিষ্কার যে এ বিদ্রোহের অংশীদার বর্তমান ক্রিকেটারদের সবাই-ই। কার্যত নেতৃত্বে সাকিব। তবে এটা তাঁর একার যে নয়, সেটি বোঝাতেই ১১ দফা পড়ে শুনিয়েছেন ১০ ক্রিকেটার। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়া নাঈম ইসলাম, এনামুল হক জুনিয়রও পাঠ করে শুনিয়েছেন ক্রিকেটারদের দাবিনামা।

১১ দফার প্রথমটাই ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি সংবলিত। দীর্ঘদিন ধরেই কোয়াবের সঙ্গে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ক্রিকেটাররা। তাই বর্তমান কমিটি বাতিল করে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যকর খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি পরিচালনার দাবির কথা শুনিয়েছেন নাঈম ইসলাম। এরপর এক, দুই করে ১০ ক্রিকেটার পড়ে শুনিয়েছেন তাঁদের ১১ দফা দাবি।

মাহমুদ উল্লাহ নিজের পালায় ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটে প্লেয়ার্স ড্রাফট তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। অতীতে সংশ্লিষ্ট ক্লাবের সঙ্গে দেনদরবার করে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে পারতেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু এখন বোর্ড থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ক্রিকেটারদের বেতন। তাতে আয় কমেছে ক্রিকেটারদের। আর এ নিয়ম করার সময় বোর্ড সভাপতি স্বয়ং বলেছিলেন যে নিয়মটা বহাল থাকবে এক মৌসুম। কিন্তু তিন মৌসুম পেরিয়ে গেলেও এটা আর বাতিল হয়নি।

মুশফিকুর রহিম তুলেছেন বিপিএল প্রসঙ্গ। এবার নতুন নিয়মে বিপিএল খেলা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই ক্রিকেটারদের। তবে আগামী মৌসুম থেকে পুরনো নিয়মে বিপিএল আয়োজনের পাশাপাশি বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে স্থানীয়দের পারিশ্রমিকের ব্যবধান কমানোর দাবি পড়ে শুনিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ভিনদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মতো বিপিএলের ড্রাফটেও যেন ক্রিকেটারদের নিজের মূল্যমান নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হয়।

সাকিব দাবি তুলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধির। বর্তমানে জাতীয় লিগের ম্যাচ ফি ৩৫ হাজার। সেটাকে বাড়িয়ে এক লাখ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে দৈনিক ভাতা এবং যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি ম্যাচ চলাকালে জিম এবং সুইমিং পুল আছে এমন হোটেলে আবাসনের নিশ্চয়তা চেয়েছেন সাকিব। সর্বোপরি, বিভাগীয় শহরগুলোয় পর্যাপ্ত ক্রিকেট অবকাঠামো গড়ার দাবি এ কারণেই যে, তাতে জাতীয় দলের বাইরে থাকা ক্রিকেটাররা সারা বছর নিজের ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে পারবেন।

এনামুল হক জুনিয়র শুনিয়েছেন চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা বৃদ্ধির দাবি। সংখ্যাটা ৩০ করার পাশাপাশি বেতনবৃদ্ধিও চান ক্রিকেটাররা।

তামিম ইকবালের দাবি ক্রিকেটারদের স্বার্থেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যারা মাঠ-উইকেট প্রস্তুত রাখেন সেই মাঠকর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির কথা বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে স্থানীয় কোচ, ফিজিও, ট্রেনার এবং আম্পায়ারদের বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন তামিম।

ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচসংখ্যা বাড়ানোর দাবি শোনা গেছে এনামুল হক বিজয়ের কণ্ঠে। একসময় জাতীয় লিগের চার দিনের ম্যাচের পর একটি ওয়ানডেও অনুষ্ঠিত হতো। পুরনো সেই রীতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বিপিএলের আগে আরেকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজনের পক্ষে ক্রিকেটাররা।

নুরুল হাসানের দাবিও ঘরোয়া ক্রিকেটকেন্দ্রিক। ঘরোয়া ক্রিকেটের সূচি যেন অপরিবর্তিত থাকে। তাতে ক্রিকেটাররা ক্যালেন্ডার দেখে নিজেকে প্রস্তুত রাখার কাজটা সেরে নিতে পারবেন।

শেষ দাবি নিয়ে মঞ্চে উঠেছেন ফরহাদ রেজা। তাঁর দাবি, ক্রিকেটারদের জন্য বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে অংশ নেওয়ার বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া। আন্দোলনে যাওয়া ক্রিকেটাররা মনে করছেন যত বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলা যাবে ততই উন্নত হবে স্কিল।

এসব দাবি-দাওয়া উত্থাপন শেষে আবার মাইক্রোফোনের সামনে সাকিব আল হাসান, ‘এ দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বিরত থাকব।’ আসন্ন ভারত সফরও এর আওতাভুক্ত কি না—এমন প্রশ্নে সাকিবের উত্তর, ‘বললাম তো, এ বিষয়গুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্রিকেটীয় কার্যক্রমে অংশ নেব না।’

তার মানে, জট না খুললে ভারত সফরের ভাগ্যে মেঘের ঘনঘটা। ১৯৯৯ সালে এমসিসির বিপক্ষে অখ্যাতদের নিয়ে বিকল্প একটি দল গঠন করেছিল বিসিবি। এবার অবশ্য সে রকম হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ারই কথা ঊর্ধ্বতনদের। আগামী পরশু শুরু হতে যাওয়া জাতীয় লিগের তৃতীয় পর্ব পিছিয়ে যাওয়া একরকম নিশ্চিতই। দ্রুততম সময়ে উদ্ভূত সংকটের সমাধান হলেও নির্দিষ্ট ভেন্যুতে যাতায়াতের ব্যাপার রয়েছে।

অবশ্য বহুদিনের চর্চিত বিষয়গুলোর জট কবে খুলবে, কে জানে। তবে নানা সময়ে ক্রিকেটারদের এমন আন্দোলনের খবর এলেও এতটা সংগঠিত কখনোই মনে হয়নি তাঁদের। ক্রিকেট প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের এটা চিন্তারই কথা! জানা গেছে, দুপুরে ক্রিকেটারদের সংবাদ সম্মেলনের খবর চাউর হতেই বিসিবির নীতিনির্ধারকরা ছুটে গেছেন বেক্সিমো ফার্মাসিউটিক্যালসের অফিসে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে বসে তাঁরা কতটা ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে পেরেছেন, সেটি অবশ্য জানা যায়নি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন