ভরসাপুরে উদ্যোগক্তার মহা উদ্যোগ

  14-10-2018 05:43PM

পিএনএস, মোল্যা হাফিজুর রহমান, বাগেরহাট থেকে : খুলনা-মোংলা মহাসড়কের ভরসাপুর বাস স্টান্ড রেখে ২’শ গজ দুরে সড়কের পূর্ব পাশে দেখা গেল ছোট ছোট কয়েকটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড পাশেই দেখা মিললো প্রায় আড়াই একর জমির উপর একটি ফল-মূল ও সাক-সব্জির বাগান। কৌতুহল বশতঃ বাগানে ঢুকে এক পাশে দেখা গেল সারি সারি উন্নত জাতের আম গাছ। তার পাশেই রয়েছে পেঁপে গাছের সারি। হাটতে হাটতে এভাবেই ওই বাগান ঘুরে দেখা গেল মৌসুমী সাক-সব্জির ক্ষেত, বিভিন্ন ফলের গাছ। এর একটু পাশেই দেখা মিললো আঙ্গুর বাগানের মাচা ও বারো মাসি জামরুল, আমড়া, দো-ফলা নিম ও আম গাছ।

বাগান পেরুলেই পাশেই চোখ পড়লো কয়েকটি পুকুর। এক পুকুরে দেখা গেল দেশী প্রজাতির খড়ুল (খড়সোলা) মাছ, অপর পুকুরে দেশী প্রজাতির শৈল, টাকিসহ অন্যান্য মাছ। পুকুরের পাশ দিয়ে হেটে এসে ছোট ছোট কয়েকটি হাঁস-মুরগীর ঘর দেখা গেল। বিভিন্ন ক্ষেত-খামরে হাঁস-মুরগীরা চরে পোকামাকড় খেতে দেখা গেল।

দেশীয় শাক-সব্জি ও ফল-মূলের পাশাপাশি উন্নত জাতের বেগুন, টমেটো, পুঁইশাক, ডাটা শাক, পালন শাকসহ বেশ কিছু সব্জির ক্ষেত চোখে পড়লো। বাগান ও ক্ষেতগুলিতে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেল। তাদের ভেতর সোয়াইব নামের একজন শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা গেল তিনি ৫ বছর ধরে ওই বাগানে কাজ করে আসছেন। তিনি জানান, এহেনি জৈব বালাই নাশুক ও মেহেগেনী ফলের ত্যাল (তৈল) দিয়ে শাক-সব্জির চাষ করা হয়, ম্যালা দুরিত্বে গাড়ি নিয়ে মানুষ-জন আইসে এহেন্দে শাক-পাতা ও ফল-টল কিনে নিয়ে যায়। এহেনি কোন গাছে বিষ-টিস দিয়া অয়না। একই কথা জানালেন অপর কর্মচারী কুদ্দুস মিয়া।

বাগানের কর্মচারীদের সাথে কথা বলার সময় বাগানের গেটে একটি প্রাইভেট কার থামতে দেখা গেল। গাড়ী থেকে নেমে এক ভদ্রলোক গেট পেরিয়ে বাগানে প্রবেশ করলেন। তিনি এসে বাগান ঘুরে বাগানের কর্মচারীদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের ফল-মূল ও শাক সব্জি সংগ্রহ করে মেপে ৩টি ব্যাগে রাখেন। আলাপ চারিতায় তার পরিচয় জানা গেল। তিনি মোংলা এলাকায় অবস্থিত দুবাই বাংলাদেশ সিমেণ্ট মিল্স লিমিটেড এর নির্বাহী পরিচালক এমডি শামীম হোসাইন। তিনি জানান, শাক-সব্জি উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে কিন্তু বিষ মুক্ত শাক-সব্জি উৎপাদনে এখন ও পর্যন্ত আমাদের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। কৃষি বিজ্ঞানি সৈয়দ আব্দুল মতিন সাহেব বিষমুক্ত শাক-সব্জি উৎপাদন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই খামারে শাক-সব্জি ও ফল-মূল উৎপাদন করার পর আমিসহ অনেকেই এই খামার থেকে চাহিদা মত শাক-সব্জি ও ফল-মূল ক্রয় করে থাকি। জাতীয়ভাবে এ ধরনের অর্গানিক পদ্ধতিতে আরও বিষ মুক্ত শাক-সব্জি ও ফল-মূল এর খামার স্থাপন এবং দেশব্যাপী মতিন সাহেবের এই উদ্যোগকে ব্যাপকভাবে প্রচার ও সম্প্রসারণ করা গেলে এক সময় বাংলাদেশে বিষ মুক্ত শাক-সব্জি ও ফল-মূল উৎপাদনে সয়ংসম্পর্নতা অর্জন করা সম্ভব হবে।

স্থাণীয় ভরসাপুর আইপিএম ক্লাবের সভাপতি শেখ আনসার আলী জানান, কৃষি বিজ্ঞানী মতিন স্যার বিষ মুক্ত অর্গানিক খামার স্থাপন করায় এ এলাকার চাষীরা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হয়েছেন। ভেশজ কীটনাশক ও জৈব সার দিয়ে খামারীরা খামার করায় ব্যাপকভাবে ফসলের উৎপাদন বেড়ে গেছে। তিনি এমন খামার স্থাপনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।

ফিউচার অর্গানিক ফার্ম নামের ওই খামারের উদ্যোগক্তা ও কৃষি বিজ্ঞানী সৈয়দ আঃ মতিন এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, নিজের দ্বায়বোধ থেকে এমন খামার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ২০১২ সালে রামপাল উপজেলার ভরসাপুর এলাকায় ২ একর জমি নিয়ে এই খামার স্থাপন করি। পৃথিবী ব্যাপি শাক-সব্জি ও ফল-মূল উৎপাদনে ব্যপক হারে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এতে খাদ্যে বিষের পরিমান অনেক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের শরীরকে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। জমিতে ৫ ভাগ জৈব সার থাকা কথা থাকলেও এখন তার একভাগ ও নেই।

প্রতিনিয়ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে মাটির অনুজিব ধ্বংস হয়ে গেছে। যে কারনে মাটির প্রাকৃতিক গুনাগুন একেবারেই নষ্ট হয়েছে। পূর্বে কেচো মাটিতে প্রাকৃতিক ভাবে সার তৈরি করতো। এখন সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। তার পরিবর্তে কেচোকে ব্যবহার করে ভার্মি কম্পোষ্ট সার তৈরি করা হচ্ছে। সারাবিশ্বে অর্গানিক জৈব সার নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক (বিষ) ব্যবহারের ফলে মাটি, পানি ও বায়ু দূষন বেড়ে চলেছে। এর থেকে পরিত্রানের জন্য কেমিক্যাল ছাড়া অর্গানিক সার ও ভেষজ কীটনাশক ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। এতে শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সাফল্য পাওয়া গেছে।

তার ওই অর্গানিক ফিউচার ফার্মে নিজের উৎপাদিত মেহগনী তৈল, মেহগনী খৈল ও ভার্মি কম্পোষ্ট সার ব্যবহার করায় ব্যপক সাফল্য পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান। কীটনাশকের পরিবর্তে মেহগনী তৈল দিয়ে তিনি শাক-সব্জি ও ফল-মূলের পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন করছেন। এতে সাফলতা ও মিলেছে। মেহগনী ফলের নির্যাস দিয়ে কীটনাশক তৈল উৎপাদন ছাড়াও তিনি মেহগনী হারবাল সোপ, মেহগনী চা ও ফফ উকূননাশক তৈল, মসকিটো রিপ্লান্ট ও জৈব খৈল উৎপাদন করছেন। একটি কৃষি ফার্ম করলেই হবেনা, সেটি ইকো সিস্টেমে তৈরি করতে হবে। এই ফার্মের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের মৎস্য চাষ ও হাঁস-মুরগী পালন ও করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গবেষনা শুরু করি। খুব অর্থ কষ্টের ভেতর দিয়েও আমার এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। অদূর ভবিষ্যতে বিষমুক্ত কৃষিজ পন্য উৎপাদনে একটি অর্গানিক ফুড পার্ক স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মোতাহার হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, কৃষি বিজ্ঞানী সৈয়দ আঃ মতিন সাহেবের অর্গানিক কৃষি ফার্ম বাংলাদেশে এই প্রথম স্থাপন করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ জাতীয় অর্গানিক ফার্ম বাংলাদেশে আরও স্থাপন করা হলে বিষমুক্ত কৃষিজ পন্য উৎপাদনে বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হতে পারে। এ জন্য তিনি সরকারি বেসরকারিভাবে সকলকে এগিয়ে আসার জন্য মত প্রকাশ করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার কুমার পাল এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, আঃ মতিনের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এধরনের অর্গানিক ফার্ম দেশব্যাপি স্থাপন করা গেলে কৃষিতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন