আধুনিক বিনোদগঞ্জের প্রাণ পুরুষ রায় সাহেব

  17-01-2019 06:00PM

পিএনএস, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি : ‘‘এমন ভুবন করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন” এ বাণি মহামানবের হয়। দেশের দক্ষিণ সুন্দরবন লোকঘেষা জনপদ খুলনা জেলার কপিলমুনি জন্ম নেওয়া প্রাণ পুরুষ রায় সাহেব। কপিলমুনি একটি নাম, একটি ইতিহাস। শত বছর আগে জঙ্গল পরিষ্কার মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করেন। শুরু হয় দেশ-বিদেশে নৌপথে ব্যবসা বাণিজ্য। উন্নয়নের ছোয়া না লাগায় আতœসামাজিক সহ ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন থেমে যায়। এমন সময় দেবদূত হয়ে কপিলমুনি জন্ম নেন বিনোদ বিহারী সাধু। মহান এই মানবের জন্ম ১৮৯০ সালের ২০মে শুক্লাষ্টমী তিথীতে। পিতা যাদব চন্দ্র সাধু, মাতা সহচরী দেবী, পিতামহ ভরত চন্দ্র সাধু, পিতামহী অমৃতময়ী দেবী। পিতা মাতার চার পুত্রের তৃতীয় তিনি। কপিলমুনি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে পায়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে বিশ্ব বরেণ্য বৈজ্ঞানিক স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত রাড়–লীর আর কে বি কে হরিশচন্দ্র ইনষ্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠেন তিনি, আর এখানেই তাঁর ছাত্র জীবনের যবনিকা ঘটে।

পারিবারিক জীবনে তাঁর বিয়ে হয় পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। ৪ পুত্র ও ৩ কন্যার জনক তিনি। কনিষ্ঠপুত্র বজ্র বিহারী সাধুর অকাল মৃত্যু হয়। অন্য ৩ পুত্র গোষ্ট বিহারী সাধু, যুমনা বিহারী সাধু ও গোলক বিহারী সাধু পরিণত বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। কপিলমুনি বাজারেই রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ব্যবসা জীবনের (১৯৩০সাল থেকে ১৯৪১সাল) ১১বছর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এলাকার মানুষের ভাগ্যন্নোয়নের বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি পূর্বপুরুষদের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কপিলমুনি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। মাতার নামানুসারে ১৯২৬ সালে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দির স্কুল, যা উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। সময়ের প্রয়োজনে বর্তমানে বিদ্যালয়টি কলেজিয়েটে রুপ নিয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে এলাকার মানুষদের সাবলম্বী করে তোলার লক্ষে অমৃতময়ী টেকনিক্যাল স্কুল, লেদ, তাঁত, সুগার মেশিন স্থাপন ও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করেন। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু তৎকালীণ ৩ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য নিজ অর্থে পিতামহের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ২০ শয্যা ভরত চন্দ্র হাসপাতাল। কালক্রমে হাসপাতালটি সরকারি হওয়ার পর ১০শয্যা করা হয়। এমনকি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকার হাসপাতালটির দিকে উন্নয়নের দৃষ্টি দিয়ে আজও তাকায়নি এমনই অভিযোগ এলাকার হাজারো মানুষের।

সময়টা ছিল এমন যে, বৃহত্তর খুলনা জেলার জন্য এক্স-রে মেশিন ছিলনা। তাই পিতামহের নামে নিজের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ভরতচন্দ্র হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন বসানোর জন্য তিনি জার্মানীতে মেশিনের অর্ডার দেন। মেশিনটি দেশে আনা হয়, সে সময় খুলনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুরোধে ১৯৩৬ সালের ৮জানুয়ারি খুলনা সদর হাসপাতালে নিজ খরচে ভবন নির্মাণ করে ঐ ভবনেই এক্স-রে মেশিনটি স্থাপন করেন তিনি। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর কর্মময় জীবন সম্পর্কিত তথ্য অনুসন্ধানে একে একে বেরিয়ে এসেছে সমাজ সেবার এক বিরল ইতিহাস।

কপিলমুনি বাজার থেকে পূর্বদিকে প্রতাপকাটী অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের জন্য নাছিরপুর খালের উপর একটি কাঠের পুল (বর্তমানে ব্রিজ) নিজ অর্থে তৈরী করে ঐ পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে দেন। কপোতাক্ষ নদের উপর কপিলমুনি নিজ অর্থে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তনেন তিনি। কিন্তু অনেকের বিরধিতার কারণে সেটা হয়নি, তবুও নিরাশ হননি। তিনি সেতু নির্মাণের জন্য কলকাতার সেন্ট্রাল ব্যাংকে লক্ষাধিক টাকা রেখে যান। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু জনস্বার্থে বাজারের মধ্যভাগে প্রায় ২ একর জমিতে পুকুর খনন করেন। যার নাম দেওয়া হয় সহচরী সরোবর। নিজ প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয় ও ভরতচন্দ্র হাসপাতালের জন্য খুলনা জেলা পরিষদে তৎকালীন ৩২ হাজার টাকা রেখে যান। কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির এর অর্থ যোগানের জন্য কলকাতা রিজার্ভ ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা সঞ্চয় রাখেন। বাংলা ১৩৩৯ সালে স্থাপন করেন “বিনোদগঞ্জ”। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংকের দেওয়ালে শ্বেতপাথরে লিখে যান “ভাবী বংশধর কভু না পাইবে ইহার ভবিষ্যৎ আয়। ব্যয়িত হইবে পল্লীমঙ্গলের তরে, যে সদপ্রতিষ্ঠান পিতৃস্তৃতি রক্ষা হেতু করিনু স্থাপন, জানিব সফল মম এজনম, বিধি এ প্রানের বাসনা মোর করিলে পুরণ। আর প্রতিবেশী সদা থাকিবে সুখে, ইহার উন্নতি কামনা যদি করে অহরহ”। বাংলা ১৩৩৮ সালের ২ কার্ত্তিক প্রতিষ্ঠা করেন সার্বজনীন বেদ মন্দির। বৃটিশ ভারতের রাজত্বে চার কোণে অবস্থিত বেদ মন্দিরের মধ্যে দক্ষিণ পূর্বক কোণের ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য মহা পবিত্র বেদ মন্দির এটি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি সমাজ সেবায় আতœ নিয়োগের উজ্জল দৃষ্ঠান্ত রেখেছিলেন। যেটি তৎকালীণ ব্রিটিশ সরকারের নজরে আসে, আর এ জন্যই তাঁকে রায় সাহেব উপাধীতে ভূষিত করা হয়। সবকিছু ঠিক ঠাক চলছিল, কিন্তুু হঠাৎ করে যেন ইহলোক থেকে বিদায়ের সুর বেজে উঠলো তাঁর হৃদয় মন্দিরে। জীবনের স্বল্প সময়ে অধিক শারীরিক ও মানসিক শ্রম দিয়ে শরীরটা যেন একেবারেই ভেঙ্গে যায় তাঁর। ভাগ্যটা এতোই প্রতিকূল যে, বেরী বেরী রোগন এই মহান মানুষটিকে পৃথিবী নামের কর্মক্ষেত্র থেকে কেড়ে নিল। কলকাতার সকল চিকিৎসকের সাধনা বিফল করে ১৩৪১ সনের ৩রা মাঘ ইহলোক থেকে বিদায় নেন।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল




@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন