নিমাই চন্দ্র কারিগর ১১০ বছরেও মজবুত!

  20-01-2019 04:03PM

পিএনএস, তানোর (রাজশাহী) সংবাদদাতা : সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন দশ বছর আগে। এখনো অব্যাহত রেখেছেন জীবন ও জীবিকার অক্লান্ত ইনিংস। একেকটা দিন একটা ইতিহাস তৈরি করে এগিয়ে চলেছেন অপরাজেয় নিমাই চন্দ্র কারিগর।

তবে জীবনের ছন্দপতন হয়েছিল ৩৫ বছর আগে। প্রিয়তমা স্ত্রী না ফেরার দেশে চলে যায় সে সময়। তারপর একাই চালিয়ে যাচ্ছেন সাংসারিক জীবন। চল্লিশের চালশে, ষাটের বার্ধক্য, সত্তরের পৌঢ়ত্ব এসব ছাপিয়ে নিমাই চন্দ্র কারিগর এখনো এগিয়ে চলেছেন আপন গতিতে।

দৃষ্টিশক্তি এখনো ঝাপসা হয়নি, কথা বলেন সাবলীলভাবে। আশার কথা, এখনো দুই পায়ে মাড়িয়ে চলেন একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে বিক্রি করেন পাঁপড়। এই জীবনযোদ্ধা বাস করেন রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার গোল্লাপাড়া গ্রামে। তিন মেয়ে থাকেন ভারতে। অন্যের জায়গায় একটি ছোট্ট একচালা ঘর বানিয়ে বাস করছেন এই শতবর্ষী।

নিজেই রাঁধেন, কাপড় কাচেন। খেতে ভালোবাসেন শাকসবজি, মাছ, ডাল, ডিম। একসময় বাদামের তেল খুব প্রিয় ছিল তার। কিন্তু সেই ভাগ্য আর হয়ে ওঠে না। হাতেপায়ে সরিষার তেল মেখেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান নিমাই চন্দ্র কারিগর। অবসরে বেড়িয়ে পড়েন গুরুঠাকুরের সঙ্গে শিষ্যের বাড়ি।

শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, তিনি ভাত রান্না করে বেগুন ভর্তা করছেন। পাশে আলু ভর্তা ও ডাল ভর্তার বাটি। জানলেন, ‘নিজেই সব রান্না করে খান। অন্যের হাতের রান্না ভালো লাগে না। তবে গুরুঠাকুরের সাথে শিষ্যের বাড়িতে গেলে শুধু ফলমূল ও দুধ খান।’

আফসোস করে তিনি জানালেন, ‘এখন নাকি সব কিছুতেই ভোজাল! রান্না করেন সরিষার তেল দিয়ে। আগে এক বিঘা জমিতে একবার আবাদ করে ১০ মণ ধান পাওয়া যেতো। খেতেও সুস্বাদু ছিলো। এখন তিন ফসলী জমিতে অনেক ধান পাওয়া গেলেও সেই পুরনো দিনের মতো স্বাদ নেই।’

আমাশয়ে তিনি বরই টক খান। তাতে আমাশয় সেরে যায়। সর্দি-জ্বর হলে সরিষার তেল গরম করে বুকে-পিঠে দেন এতে উপশম হয়। শরীর কোথাও কেটে গেলে লবণ দিয়ে বেঁধে দেন। আস্তে আস্তে সেই ক্ষতস্থান পূরণ হয়ে যায়। খুব খারাপ অবস্থা না হলে তিনি কখনও চিকিৎসকের কাছে যান না।

৪৭-এর দেশ ভাগের সময় তার বয়স ছিল ৩৮ বছর। সেই সময় স্বদেশী আন্দোলনে জমিদার পুত্রদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। দেশভাগের পর তিনি ভারতে যান। সেই সময় নাকি মহিষের লেজ ধরে রাজশাহীর পদ্মানদী পার হয়েছিলেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশে সিরাজগঞ্জ সদরের ধানবাঁন্ধি এলাকায়। পরে পার্বতীপুর ঔষুধের ল্যাবটারীতে পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি করেন।

কারিগর বলেন, ’৫৪ সালের দুর্ভিক্ষে খুব কষ্ট পেয়েছি। সেই দুর্ভিক্ষের সময় খেসারি ডালের ছাতু ও মিষ্টি আলু খেয়ে কাটিয়েছি। এমন কষ্টের দিনে মানুষ একটু খাওয়ার জন্য বাড়ি-ঘর পর্যন্ত মানুষকে দিয়ে দিতো। এখন সেইসব কথা মনে হলে খুব কষ্ট হয়।’

বর্তমানে বেঁচে নেই তার সমবয়সী কোনো বন্ধু। ১০ বছরের ছোট শতবছর বয়সী লালপুরের হাজ্বী এরশাদ মেম্বারও মারা গেছেন। তানোর উপজেলায় তার বয়সী কেউ জীবিত নেই বলে তিনি জানান।
গোল্লাপাড়া গ্রামের গৌতম কুমার দাস কারিগর সম্পর্কে বলেন, ‘দাদুর অসুখ-বিসুখ তেমনভাবে দেখা যায় না। তবে শরীরের কোন স্থান কেটে গেলে লবণ দিয়ে কাপড় পেচিয়ে বেঁধে দেন। কিছুদিন পর ওইস্থান পুড়ে ভালো হয়ে যায়। পাঁচফোড়ন ও তেজপাতা পুড়িয়ে এতো সুন্দর ডাল রান্না করেন যে চারিদিকে ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায়। এখনও নিজেই রান্না করে খান। খাওয়া-দাওয়ায় বেশ পটু কারিগর দাদু।’

উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুনীল দাস, গোল্লাপাড়া গ্রামপ্রধান বিশ্ব দাসসহ একাধিক ব্যক্তিরা জানান, ‘কারিগরকে তারা জন্মের পর থেকে একইভাবে দেখছেন। আগের মতোই কারিগর এখনও পূজা, হরিবাসর কিংবা যে কোনো অনুষ্ঠানে পাঁপড় বিক্রি করেন। সেই আগের মতোই তাকে দেখছি। তার যেন বয়স বাড়ে না!

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল




@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন