ফিরে দেখা ’৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে

  20-02-2019 05:42PM

পিএনএস, মোঃ আজিজুর রহমান ভূঁঞা বাবুল (ময়মনসিংহ প্রতিনিধি) : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরের সন্তান ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে নানার বাড়িতে শৈশব কাটানো নুরুল আমিন। তখনকার প্রেক্ষাপটে প্রবল-প্রতাপশালী মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজ এলাকা ময়মনসিংহে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আরো বেশি তীব্রতা পায়। ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলা,মহকুমা এমনকি জেলার প্রতিটি থানা পর্যায়ে সারা দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা ছিল রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে। নুরুল আমিনের ছেলেবেলায় বেড়ে উঠা ,আইনজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর পূর্বপাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে আসীন হওয়া নিজ এলাকা ময়মনসিংহে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ভন্ডুল করতে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দমন-পীড়নের মাত্রাও ছিলো এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। তবুও ময়মনসিংহবাসী নুরুল আমিনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াতে মানুষের মনে দৃশ্যমান করতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহনে পিছ পা হয়নি।

ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখক আবুল মনসুর আহাম্মদ এর সভাপতিত্ত্ব ময়মনসিংহ শহরের বিপিন পার্কে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ জনসভাটি অবশ্য সর্বদলীয় জনসভা হিসেবে বিবেচিত হয়। সভা শেষে মিছিল বের হয়। সে সময়ে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। শুধু তাই নয় মুসলিম লীগের পোষা গুন্ডারা মিছিলে হামলাও করে। এতে আহত হন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। একে আন্দোলনের সূচনা বা সচেতনতা পর্ব বলা চলে।

পরবর্তীতে ওই পেক্ষাপটে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যাপক সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইনকে সভাপতি ও নান্দাইলের মুশুল্লীর মেরেঙ্গা গ্রামের কৃতিসন্তান রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াকে সম্পাদক করে ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয় ।

সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত ও পরিচালনায় ময়মনসিংহ জেলা,মহকুমা ও থানাগুলোয় ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি যথাযথভাবে পালিত হতে থাকে। ওই পেক্ষাপটে ২৩ ফেব্রয়ারি ময়মনসিংহ শহরসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়।শহরের বিপিন পার্কে সভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচিও অব্যাহত থাকে।

এ পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ হয়ে ওঠে প্রবল প্রতিবাদী শহর। ২৪ ফেব্রুয়ারি রোববার ছুটির দিনেও শহরের পথে পথে মিছিল আর শ্লোগান চলতে থাকে। শহরের সর্বত্র প্রতিবাদী পোস্টার আর কালো ব্যাজ ও কালো পতাকায় শহরটিকে যেন চেনা যায় না। শুধু দোকানপাটই নয়, হাটবাজারও বন্ধ, মানুষ তাতে কোনো প্রতিবাদ করছে না।

ওই অবস্থার মোড় ঘোরাতে ‘মুসলিম লীগ’ ময়মনসিংহ শহরের টাউন হলে জমকালো এক সভার আয়োজন করে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক জনতার ক্ষুদ্ধ প্রতিবাদে উদ্যোক্তারা সভাস্থল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে জেলা শহরের সৃষ্ট আন্দোলনের আবেগ ও বেগ বেড়ে শহর থেকে দূরে মহকুমা, থানা ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জে পৌঁছে যায়। গোটা ফেব্রুয়ারি মাস অদ্যাবধি এ অবস্থা চলে। জের গড়ায় মার্চ মাসেও।

অচলাবস্থা কাটাতে প্রশাসন ব্যাপক গ্রেফতারের পরিকল্পনা ও দমননীতির সিদ্ধান্ত নেয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াসহ সংগ্রাম কমিটির অধিকাংশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তা সত্ত্বেও আন্দোলন পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ময়মনসিংহের সংগ্রাম কমিটির সভাপতি সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইনকে ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।তার আগেই ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রফিক উদ্দিন ভূঁঞাসহ আন্দোলন স্তব্ধ করতে বিভিন্ন সারির ২৩ জন নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার আচারগাঁও গ্রামের আরেক কৃতি সন্তান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বাংলা ভাষা দাবি আদায়ের অহংকার খালেক নেওয়াজ খান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হওয়া মাত্রই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দায়িত্ব পালন করেন অগ্রসেনানীর। তিনি গ্রেফতারও হন শুরুতেই।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তার সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয় খালেক নওয়াজ খানকে। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার নতুন করে নিজেকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। ৫২’র ২৭ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। এ পরিষদের একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে খালেক নওয়াজ খান আবার ভাষা আন্দোলনকে সুসংহত করেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহে গঠিত সংগ্রাম কামটির সম্পাদক ছিলেন নান্দাইলের মুশুল্লীর মেরেঙ্গা গ্রামের কৃতিসন্তান রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া। ১৯৪৭ সালে কলিকাতা সিটি কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তির হয়ে রাজনীতির সম্মুখ সারিতে চলে আসেন।১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ আড়াই বছর তাকে কারাবন্দী থাকতে হয়।১৯৫৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৩ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বেসামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহের গভর্ণর নিযুক্ত হন।জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ও কাছের মানুষ রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া বালাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন,১৯৫৮ সালে আইযুব খাঁনের দুঃশাসন,৬ দফা, ’৬৯এর গণআন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলনে বার বার জেল কেটে জাতির জনকের স্নেহধন্য হিসেবে নাম লেখানো এ বীরের অসামান্য অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রচার বিমূখ এ রাজনীতিক বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বীরের ভূমিকা পালন করলেও এতোদিন পরও সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘একুশে পদক’ না পাওয়ায় ময়মনসিংহের মানুষের মনে কষ্ট থেকেই যাচ্ছে।

ময়মনসিংহের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ভালুকার মোস্তফা এমএ মতিন। কিশোর বয়স থেকেই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন আন্দোলনে একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে তিনি নিজেকে উদ্ভাসিত করেন। নেতৃত্ব দিতে গিয়েই তিনি গ্রেফতার হন। তার সঙ্গে আরও অনেককেই এ সময় কারাভোগ করতে হয় ভাষা আন্দোলনে যোগদান করার অপরাধে। তাদের মধ্যে ময়েজ উদ্দিন, কামরুজ্জামান, আবদুল মোমেন তালুকদার, মোজাফফর আহাম্মদ অন্যতম।

ময়মনসিংহের ভাষা আন্দোলনকে আরও গতিসিদ্ধ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন ফুলপুরের এম শামসুল হক ও গৌরীপুরের আহমেদ সালেক। শামসুল হকের গ্রামের বাড়ি জেলার ফুলপুর উপজেলায় হলেও তার বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরেই। ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া শামসুল হক পাঁচবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ ভাষাসৈনিকের আরেক ভাই মোজাম্মেল হকও ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন।

জেলার গৌরীপুর উপজেলার আরেক অন্যতম ভাষাসৈনিক আহমেদ সালেক ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সরকার তাকেও গ্রেফতার করে। আহমেদ সালেক ভাষা আন্দোলনের সৈনিকই শুধু ছিলেন না, গণমানুষের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন সংগ্রামে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল যে কারও নজর কাড়ার মতো। তা ছাড়াও গৌরীপুরের ভবানীপুর গ্রামের শিক্ষাবিদ ও লেখক আবুল কাসেমের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য।

নুরুর আমিনের নির্বাচনী এলাকা ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইলে দমন-পীড়নের মাত্রা বেশি থাকলেও আন্দোলনের গতিও ছিলো আরো তীব্র। ঈশ্বরগঞ্জ এলাকায় হাসিম উদ্দিনের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য। এসময় নিজ এলাকায় আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ঢাকা থেকে কবি আব্দুল হাই মাশরেকী ঈশ্বরগঞ্জে এসে তরুণদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলনে গতি সঞ্চার করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। ঈশ্বরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গোপনে মিটিং করে কবি আব্দুল হাই মাশরেকী এলাকার মোসলেম উদ্দিন খান,বরুণ ঘোষসহ স্থানীয় অনেকেই নিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর মধ্যে ঈশ্বরগঞ্জের সোহাগী গ্রামের শামছুল হুদাও ছিলেন।

১৯৫২ সালে কবি আব্দুল হাই মাশরেকী’র রাষ্ট্রভাষার উপর একটি কবিতা লেখেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই নইলে বাংলা রাষ্ট্র চাই’ কবিতাটি তখন তমুদ্দুন মজলিশ এর একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়।

নুরুর আমিনের ছোট বেলায় বেড়ে উঠা মামার বাড়ি নান্দাইল নিজ এলাকায় রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের আগুন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আরো বেশি। কারণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আরেক অহংকার খালেক নওয়াজ খান এর বাড়িও নান্দাইলে। রাজনীতিতে দুই মেরুর দুই বাসিন্দা একে অপরকে কোন কিছুতেই ছাড় দেননি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিজ এলাকায় নুরুল আমিনের প্রেষ্টিজ ইস্যু। মূখ্য মন্ত্রীর এলাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলে কারো ধর(মাথা) থাকবে না এমন হুঙ্কার দিতো নুরুল আমিনের পোষা গুন্ডারা। আর তরুণ কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা খালেক নওয়াজ খানের নির্দেশ ছিলো যুবকদের উদ্দেশ্যে ‘নুরুল আমিনকে নান্দাইলে অবাঞ্চিত ঘোষণা করতে হবে’ তার রাজনীতির লাল বাতি নান্দাইল থেকেই জ্বালাতে হবে। এসব দমন পীড়ন উপেক্ষা করে নান্দাইলে ১৯৫২ সালের ১১,১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ‘পতাকা দিবস।’ নান্দাইলে ’৫২ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়।হরতালের পক্ষে মিছিল শেষে নান্দাইলের কাচারী ময়দানে ও চন্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রসুলপুর গ্রামের মনির উদ্দিন মাষ্টারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা।এতে বক্তব্য রাখেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরবর্তীতে এদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি শাহাব উদ্দিন আহাম্মেদ,নান্দাইলের রসুলপুর গ্রামের নবী হোসেন, ঈশ্বরগঞ্জের সোহাগী গ্রামের শামছুল হুদা, নান্দাইলের আচারগাঁও পুরহরি গ্রামের তাহের উদ্দিন প্রমূখ। সভায় মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে নান্দাইলে প্রতিরোধ এবং অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রভাষার এ আন্দোলনে গ্রেফতার হন নান্দাইলের রসুলপুর গ্রামের নবী হোসেন।

এদিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ’৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে সালাম,শফিক সেইসাথে গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামের আব্দুল জব্বার শহীদ হলে ময়মনসিংহে বিক্ষোভ বা বিদ্রোহের আগুনের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। একেবারে সাধারণ ঘরের ছেলে আব্দুল জব্বার। দরিদ্রও বটে। লেখাপড়াও নামমাত্র। প্রাইমারি অতিক্রম করেছেন এই-যা। আসলে বিপ্লবের জন্য একাডেমিক শিক্ষা জরুরি নয়। প্রয়োজন সামাজিক শিক্ষার, স্বশিক্ষার, জব্বারের তাই ছিল। জব্বার কীভাবে ভাষা আন্দোলনে গেলেন, কীভাবে শহীদ হলেন, সে প্রসঙ্গে যা জানাযায়-

জব্বার কি আন্দোলনে গিয়েছিলেন ? না। আন্দোলন জব্বারকে নিয়েছিল। নিতে পেরেছিল। সাধারণ মানুষের ভেতরও আছে দ্রোহের বারুদ। জব্বার গিয়েছিলেন শাশুড়ির চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ কেনার জন্য যখন ঢাকা মেডিকেলের ফটকের কাছে আসেন, তখন দেখলেন ফটকের সামনে দিয়ে যাচ্ছে ‘ভাষা আন্দোলনের উত্তাল মিছিল’। জব্বার মিছিলে একীভূত হয়ে গেলেন। ঠিক এ সময়ই মিছিলে খাজা নাজিমুদ্দিন আর নুরুল আমিনের নির্দেশে লেলিয়ে দেয়া পাকিস্তানের পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন সংগ্রামী জব্বার। গফরগাঁয়ের অজপাড়াগাঁ পাচুয়ার সাধারণ মানুষ ‘জব্বারের রক্ত’ শুধু নিজ জেলা ময়মনসিংহে নয়, গোটা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রবাহকে উদ্দীপ্ত করেছে। বীর প্রসবা মাটি গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামের আব্দুল জব্বার ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হলে এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল গফরগাঁওয়ে। গফরগাঁও কলেজের তৎকালীন ছাত্ররাই মূলত ওই আন্দোলনটি শুরু করেছিলো। কলেজ ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারি একটি মিছিল বের হলে ওই মিছিলে অনেকেই যোগদান করেন। মিছিলটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে নেতৃত্বে থাকা ছয় ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন গফরগাঁওয়ের দুগাছিয়া গ্রামের আবদুল বাতেন, মাইজবাড়ী গ্রামের মুগবুল হোসেন। বাকি চারজন গফরগাঁও কলেজের ছাত্র হলেও বাড়ি ছিল অন্যত্র।

ভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহের এমন ভূমিকা সত্ত্বেও সেখানে শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালনের প্রাক্কালে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা শহীদ মিনার ধ্বংস করার পর স্বাধীন স্বদেশে প্রথমে ছোটখাটো আকারে, পরে ১৯৮৮ সালে টাউন হল প্রাঙ্গণে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, পৃথিবীতে ৭ হাজার ২১১টি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। বিস্ময়কর বিষয়, এতসব ভাষার মধ্যে শুধু একটি মাত্র ভাষাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও তা সফল হয়নি। লড়াই, সংগ্রাম, রক্ত আর লাশের প্রতিরোধ হত্যাচেষ্টাকে পাল্টা হত্যা করেছে। সেই একটি মাত্র ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা। বাঙালির প্রিয় মাতৃভাষা। পাকিস্তান সরকার দুঃশাসনের মাধ্যমে মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জোরপূর্বক উর্দু ভাষা চালু করতে চায়। এরূপ ঘোষণার পর এদেশের মানুষ সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। এ বিক্ষোভ বা বিদ্রোহ শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল না। ছড়িয়ে পড়ল ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। জেলা, থানা, মহল্লা সর্বত্র একটিই শ্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে নুরুল আমিনের রাজনীতির লাল বাতি জ্বলে উঠে।’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী নরুল আমিন নিজ এলাকায় তরুণ ছাত্রনেতা খালেক নওয়াজ খাঁনের কাছে ভোটযুদ্ধে পরাজিত হন। নরুল আমিনের পরাজয়ের ফলে দৈনিক ইত্তেফাকসহ বেশ ক’টি পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে “পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পরাজয়ের ঘন্টা বেজে উঠেছে” এই শিরোনামে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এসব শহীদদের রক্তের বিনিময়েই পরবর্তীতে স্বৈরাচারী আইয়ুবের ক্ষমতার অবসান ঘটে। এর পরেই আসে সত্তরের নির্বাচন, বাঙ্গালীর বিজয়,ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের নানা ছলচাতুরী প্রতারণা সর্বশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বালাদেশের জন্ম।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল




@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন