‘কৌশলী’ রোহিঙ্গারা

  16-05-2019 01:55AM



পিএনএস ডেস্ক: পাচারকারীদের প্রলোভনে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে মরিয়া রোহিঙ্গারা। নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি জীবনধারণের প্রয়োজনীয় রসদ পেয়েও উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প ছাড়ছেন তারা। নৌ-পথে মালয়েশিয়া যাবার প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মক্ষেত্র খুঁজে বাংলাদেশে স্থায়ী বসতি গড়ার পরিকল্পনায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছাড়ছেন বলেও স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন।

গত কয়েকদিনে উখিয়া-টেকনাফ, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদরের সাগরতীরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে কয়েকশ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। যারা বিবাহযোগ্য অথবা বিধবা।

এসব ঘটনায় পাচারকারীদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। ফলে রোধ হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পালানোর অপচেষ্টা।

প্রশাসনের তথ্য মতে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তুলনায় ক্যাম্পভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মীর উপস্থিতি অপ্রতুল হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পত্যাগ রোধ করা যাচ্ছে না। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভাষা, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দেয়া তাদের জন্য সহজ হচ্ছে।

বুধবার ভোররাতে কক্সবাজারের টেকনাফের নোয়াখালী পাড়া থেকে নারীসহ ৩১ মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তারা সবাই সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল। টেকনাফ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) এ বি এম এস দোহা জানান, টেকনাফের নোয়াখালী পাড়া এলাকা দিয়ে সমুদ্রপথে একদল রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন খবরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৩১ রোহিঙ্গাকে আটক করে। তারা সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির থেকে ওই স্থানে জড়ো হয়।

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে কক্সবাজারের কলাতলীর শুকনাছড়ি ও দরিয়ানগর সমুদ্র ঘাটে জড়ো করা ২৮ নারী-পুরুষ ও শিশুকে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় স্থানীয়দের সহায়তায় আটক করে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে ১৩ জন নারী, নয়জন পুরুষ ও ছয় শিশু রয়েছে। এ সময় পাচারকাজে জড়িত একটি নৌকাও জব্দ করা হয়।

একই দিন রাত ১১টায় জালিয়াপালং ইউনিয়নের লম্বরী পাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশে রাখা ২৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। পাঁচদিন আগে টেকনাফের হ্নীলা জাদিমোরা ঘাট দিয়ে তাদের বাংলাদেশে এনে তাবাইয়া নামের এক ব্যক্তি মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে লম্বরীপাড়াস্থ তার বাড়িতে পাঁচদিন রাখে।

মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারগামী যাত্রীবাহী গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নারী, পুরুষ, শিশুসহ ২৭ রোহিঙ্গাকে আটক করে উখিয়া থানা পুলিশ। তারা জানায়, কক্সবাজার লিংক রোড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে জনপ্রতি ৫০০ টাকা দালালদের দেয়া হয়। প্রচণ্ড গরমে বালুখালী ক্যাম্পে ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে পলিথিনের ছাওনিতে বাস করতে নাভিশ্বাস উঠছিল। তাই কোথাও ভাড়া বাসা নিয়ে আপতত থাকতে কক্সবাজারে এসেছিল তারা। পরবর্তীতে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল।

অন্যদিকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও মহেশখালী থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাবার জন্য জড়ো হওয়া ২০ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে রোববার রাতে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১১ নারী, সাত পুরুষ ও দুই শিশু রয়েছে।

আবার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। গত শুক্রবার ভোরে রাজধানীর খিলক্ষেতের মধ্যপাড়া এলাকার কহিনুর ভিলা থেকে ২৫ রোহিঙ্গাসহ ২৭ জনকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের অধিকাংশই কিশোরী। ওই ঘটনায় খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা হয়েছে। ২৩ রোহিঙ্গাকে আদালতের নির্দেশে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রোববার বিকেলে ঢাকা থেকে উখিয়া থানায় পাঠানো হয়।

উখিয়া থানা পুলিশ রোববার সন্ধ্যা নাগাদ উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের সাতজন, বালুখালীর দুজন, থাইংখালী ক্যাম্পের চারজন, হাকিমপাড়া ক্যাম্পের দুজন, ক্যাম্প ১৬’র একজন ও টেকনাফের নয়াপাড়া মোচনী ক্যাম্পের সাতজনসহ ২৩ জনকে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

ক্যাম্পে ফেরা কয়েকজন রোহিঙ্গা কিশোরী জানান, তাদের ভালো চাকরি দেয়ার কথা বলে রোহিঙ্গা স্বামী-স্ত্রী আইয়ুব ও আসমা আক্তার ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকায় একটি বাড়িতে অবস্থানকালে পুলিশ তাদের আটক করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ৩১টি ক্যাম্পের কোনো না কোনো ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন রোহিঙ্গারা পালাচ্ছেন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক শতাধিক মানবপাচারকারী সক্রিয় রয়েছে। তাদের নিয়োজিত দালালরা ক্যাম্পের ভেতরে ঘুরে ঘুরে নানা প্রলোভন দিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের মালয়েশিয়া যেতে উদ্বুদ্ধ করছে। তাদের কথায় রাজি হওয়া রোহিঙ্গাদের একজায়গায় জড়ো করে সুযোগ বুঝে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। গত চার মাসে প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা পাচারের শিকার হয় বলে দাবি একটি অসমর্থিত সূত্রের। গোপন পথে অনেকে মালয়েশিয়া পৌঁছে গেছে- এমন খবর পাবার পর ক্যাম্প ছাড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা মিয়ানমারের আরাকানে বিত্তশালী ছিলেন। তাদের আলিশান বাসাবাড়ি ছিল। তারা এখানে ঝুপড়ি ঘরে নিজেদের কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছেন না। তার ওপর প্রচণ্ড দাবদাহে উত্তপ্ত পরিবেশে ছোট বাচ্চা কিংবা বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে বাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে তারা প্রশান্তির আশায় ক্যাম্প ছাড়ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে বৈধ-অবৈধ সব পথেই চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

বৈধ পথে যেতে অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আকাশ পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টাও করছেন অনেকে। যারা এখানে পাসপোর্ট পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের কেউ কেউ ভারতে গিয়ে সেখান থেকে পাসপোর্ট করে স্বজনদের কাছে যাচ্ছেন। সামান্য সংখ্যক সফল হলেও অধিকাংশই ধরা পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়া সহজ- এমন প্রচারে কক্সবাজারের মানবপাচারকারী চক্রটি আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য তারা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে ফাঁদে ফেলছে। আর উন্নত জীবনের আশায় রোহিঙ্গারাও তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছে।

পাচারকারী চক্রটি রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রচার করছে যে, মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বড় জাহাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাহাজটি গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ। এজন্য রোহিঙ্গারাও ঝুঁকি নিচ্ছে।

উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিদিন রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। পথে অনেকেই ধরা পড়ছেন। আবার সাগরপাড়ে রাতের আঁধারে ধরা পড়ছেন কেউ কেউ। সড়কের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী গাড়ি ও পথচারীর বেশধরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গাদের আটক করা হচ্ছে।

‘আবার আটক রোহিঙ্গাদের থানা হেফাজতে রাখলে তাদের খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। প্রতিদিনই অসংখ্য রোহিঙ্গা পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন। এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পত্যাগ করে মালয়েশিয়া অথবা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে একদিন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই রোহিঙ্গাদের অবৈধ পথে দেশত্যাগের অপচেষ্টা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টার কমতি নেই।’

ক্যাম্প সূত্র মতে, উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা অনুপাতে সেখানে বসানো পুলিশ চেকপোস্টে লোকবলের সঙ্কট রয়েছে। সীমিত সংখ্যক চেকপোস্ট ও কম লোকবলের কারণে রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই ক্যাম্প পালানো রোধ করা যাচ্ছে না। চেকপোস্টে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিমত, রোহিঙ্গাদের ভাষাগত দিক, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় ভিন্ন জেলা থেকে আগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের শনাক্তে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। ফলে তাদের ফাঁকি দিয়ে কৌশলে ক্যাম্পত্যাগে সক্ষম হন রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, মানবপাচারকারীদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। তাদের প্রতিহত করতে কাজ করছে সব থানার পুলিশ। স্থানীয় জনগণকেও এতে সামিল হতে অনুরোধ জানান তিনি।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, তালিকাভুক্ত প্রতিটা রোহিঙ্গা পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবনধারণের পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের দেয়া অনেক পণ্য তারা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে তাদের প্রয়োজন অনুপাতে ভোগ্যপণ্য না পাওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। আগে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশি সেজে প্রবাসে গেছেন তাদের মতো সুযোগ পাওয়া যায় কিনা বা দালালদের আশ্বস্ত করা বাণী শুনে হয়তো তারা ক্যাম্প ছাড়ছেন।

‘মানবিক আশ্রয় দেয়ার কারণে সরকার তাদের সঙ্গে নম্র আচরণ করছে। এটার সুযোগ নিলে প্রশাসনকে আরও কঠোরতা দেখাতে হবে। এরপরও তাদের সারাদেশে ছড়াতে বা বিদেশ গমনের সুযোগ দেয়া হবে না। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে বিশ্বসম্প্রদায়ের সহযোগিতায় কাজ করছে সরকার।’

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন