আশুগঞ্জে ফ্যাক্টর সফিউল্লাহ-হানিফ

  19-03-2016 06:15AM

পিএনএস: তখন নৌকা ছিল না। ছিল কাপ-পিরিচ। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর এই প্রতীকের পক্ষে ছিলেন না আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগের হালের কর্তা সফিউল্লাহ মিয়া। রাগে-ক্ষোভে দলত্যাগ পর্যন্ত করেন তিনি। এরপর ব্যস্ত হন বিএনপি মনোনীত আবু আসিফ আহমেদের আনারস নিয়ে। দলের প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটিয়ে আবার ফিরে এসেছেন তিনি আওয়ামী লীগে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগী এই নেতা এখন আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি-হর্তকর্তা। ইউপি নির্বাচনে ছেঁটেছেন উপজেলা নির্বাচনে যারা দলের প্রার্থীর পক্ষ হয়ে কাজ করেছেন তাদের। আর সে কারণে আবার আলোচনায় তিনি। দলের নেতাকর্মীদের মুখে মুখে তার ‘পল্টি’ আর ‘সাইজ মিশন’র গল্প। দলের সাংগঠনিক রীতিনীতিকে কীভাবে নিজের খেয়াল-খুশিতে পরিণত করেছেন তা নিয়েও বিস্তর কথা। ইউপি নির্বাচনের মনোনয়নের পর ইউনিয়ন, উপজেলা এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও তার সমালোচনা করছেন। তার বিরোধী নেতারা বলেন, আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগ ধ্বংসের কারিগর হয়ে উঠেছেন সফিউল্লাহ মিয়া।

উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮-৯ মাস আগে ৫টি ইউনিয়ন চর-চারতলা, আড়াইসিধা, তারুয়া, তালশহর ও দুর্গাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। ইউনিয়ন নেতারা জানান, অন্য ৩টি ইউনিয়নে সফিউল্লাহর লোকজন হওয়ায় সেখানকার কমিটি ভাঙা হয়নি।

পরে এসব ইউনিয়নে নিজের লোকজনকে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় যুগ্ম আহ্বায়ক হানিফ মুন্সি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে এসব ইউনিয়নের নেতারা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে সেজন্যে তাদের কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। এরপর ইউপি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কৃত উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জিয়া উদ্দিন খন্দকার বলেন, সম্মেলনের মাধ্যমে করা ৩ বছর মেয়াদি ইউনিয়ন কমিটিগুলো দেড় বছর না যেতেই ভেঙে দেন আহ্বায়ক সফিউল্লাহ মিয়া। সাংগঠনিক কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি তিনি এক্ষেত্রে। যা করেছেন গায়ের জোরে। এরপর নিজের লোকজন দিয়ে কমিটি করেন। সেই কমিটির নেতাদেরই মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি। দুর্গাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন মাজু বলেন, আমি হানিফের লোক বলে আমার ইউনিয়ন কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। এর কারণ জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পাইনি। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গেও দেখা করেছি অনেকবার। তিনি শুধু বলেছেন, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক আর হয়নি। তারুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাদল সাদির বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন করার কারণে আমার কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। আর সফিউল্লাহ মিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি হয়ে বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচন করেছেন। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে এখতিয়ার না থাকার পরও তারা আমার কমিটি ভেঙে দিয়েছে। তিনি বলেন, সফিউল্লাহ মিয়া আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কৃত দুর্গাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেন বাদল বলেন- উপজেলা নির্বাচনে ৩০ লাখ টাকা খেয়েছে সে। এরপরই পদত্যাগ করে বিএনপির নির্বাচন করে।


আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগে প্রকট দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে। ওই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন দুজন। আবু নাসের আহমেদ আর হানিফ মুন্সি। হানিফ মুন্সি নাসের থেকে ৩২ ভোট বেশি পেয়ে সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর আসে উপজেলা নির্বাচন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন প্রার্থী হন ৪ জন। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সফিউল্লাহ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক হানিফ মুন্সি, তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মিয়া। প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের ভোট নেয়া হয়। মনোনয়ন প্রার্থী তিনজনের সম্মিলিত ভোটের চেয়ে ১১ ভোট বেশি পান হানিফ। হানিফ জানান, ২০১৪ সালের ৩১শে মার্চ নির্বাচনের ১১ দিন আগে সফিউল্লাহ মিয়া দল থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ দেখান শারীরিক অসুস্থতা। এরপর তিনি বিএনপি প্রার্থী আবু আসিফের নির্বাচন করতে শুরু করেন হোটেল উজানভাটিতে বসে। তার ছেলে সোহাগ রওশন আরা জলিল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট হয়। তিনি জানান, নির্বাচনের ৬ মাস পর সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। সম্মেলনের সময় দুটি পদই ঘোষণা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় সভাপতি পদত্যাগ করার পর সেক্রটারি হিসেবে আমিই অবশিষ্ট থাকি। এরপর আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। কিন্তু সেই কমিটিতে পদত্যাগী সফিউল্লাহ মিয়াকেই করা হয় আহবায়ক। যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগে সেক্রেটারি পদে বিপুল ভোটে হেরে যাওয়া আবু নাসের আহমেদকে। নাসের উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবু আসিফ আহমেদের ভাতিজা। এরপরই আমি হাজি মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পালটা আহ্বায়ক কমিটি করি। এ নিয়ে দীর্ঘদিন বিরোধ চলার পর সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় মিলেমিশে কাজ করার কথা বলা হয় আমাকে। আর আমার কমিটি বিলুপ্ত করতে বলে। কিন্তু আমার দাবি ছিল আমাকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করার। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুরও বলে দিয়েছিলেন আমাকে যেন ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। কিন্তু তারা শুনেনি। আমার দিক থেকে দ্বন্দ্ব মিটে গেলেও তারা ভেতরে দ্বন্দ্ব রেখে দিয়েছে। যার প্রমাণ ইউপি নির্বাচন। আমার কোনো লোককে মনোনয়ন দেয়নি। বরং যারা আমার নির্বাচন করেছে তাদের নেতৃত্বাধীন ইউনিয়ন কমিটিগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে। সফিউল্লাহ মিয়া বলেন- আসল কথা বলতে গেলে মহাবিপদ। সত্য বললে আরও বিপদ। আমার জীবনের রাজনীতিতে একটা ভুল হয়েছিল তার ব্যাপারে। হানিফ যখন সেক্রেটারি হলো তখন দেখি তার মতিগতি ভালো না। চাল-চলন ভালো না। এরে মারে, ওরে ধরে। এটা আমার জন্যে প্রবলেম হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেই। দেখলাম সে যদি উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে যায় তাহলে আরও বিপদ। তিনি বলেন, হানিফের সঙ্গে আমার কোন দ্বন্দ্ব নেই। তার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব থাকবে কেন? সে তো জাতীয় পার্টি থেকে আসা। এখনও জাতীয় পার্টির লোকজনের সঙ্গেই তার ওঠাবসা। তিনি উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচন করেননি বলেও জানান।



পিএনএস/বাকীবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন