তরুণীদের ধূমপানের প্রতি আসক্তি দিন দিন বাড়ছে

  30-04-2018 10:02AM

পিএনএস ডেস্ক: সুখপরী (ছদ্দনাম)। পড়েছেন একটি বেসরকারি বিশবিদ্যালয়ে। গতবছরই মাস্টার্স শেষ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর গত চার বছর আগে তিনি যখন হোস্টেলে থাকতেন, তখনই রুমমেটের পাল্লায় পড়ে হাতে খড়ি হয় ধুমপানের। এখন তিনি পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর মিরপুরে থাকেন। হোস্টেল ছেড়েছেন, রুমমেট ছেড়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন- কিন্তু ধূমপান ছাড়তে পারেননি। এখনো চলছে তার সেই আসক্তি। এটা নিয়ে তার মা-বাবাও খুব বিব্রত। তিনি নিজেও বিব্রত। কিন্তু ছাড়তে পারছেন না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শুধুই যে ধূমপান করেছেন, তা নয়। মদ, গাঁজা এবং ইয়াবার স্বাদও তিনি নিয়েছেন।

তিনি বলেন, এখন বাইরে তেমন একটা ধূমপান করা হয় না। বাসায় ওয়াশরুমে বা বেলকোনিতে বসে লুকিয়ে ধূমপান করি। যাতে বাবা-মায়ের চোখে না পড়ে। ধূমপান করার পর আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অল্পে অনেক রাগ হয়। কোনো কিছু ভালো লাগে না। একপ্রকার হতাশা কাজ করে।

শুধু এই তরুণী নয়, অনেক তরুণীই ধূমপানে আসক্ত। দিন দিন বাড়ছে এই সংখ্যা। নারী সংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী, মেডিকেল শিক্ষার্থী ও নামি-দামি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। কেউ স্কুল জীবন থেকে, কেউ কলেজ আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধুদের পাল্লায় বা বয়ফ্রেন্ডের পাল্লায় কিংবা ফ্যাসানে বা সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে ধূমপানে জড়িয়েছেন বা জড়াচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে ধূমপানে আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এই বয়সে কেউ ধূমপান ধরলে পরবর্তীতে সহজে ছাড়তে পারে না। যা পরিবার ও সমাজে খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ধূমপানে আসক্ত হওয়ার পেছন বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, হতাশার কারণে বা তালমিলিয়ে চলতে গিয়ে ধূমপান শুরু করে। প্রথমে শুরুটা হয় কাছের মানুষের কাছ থেকে। সে বন্ধুও হতে পারে, সহপাঠী, রুমমেট কিংবা বয়ফ্রেন্ডও হতে পারে। ধূমপান শুরুর পর ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে নিকোটিনের প্রভাবটা বেশি হয়। নিকোটিনের প্রধান কাজই হচ্ছে আসক্তি তৈরি করা। মধ্য বয়সে যতটুকু আসক্তি হবে তরুণ বয়সে আসক্তিটা দ্রুত হয়। আমরা বলি যে, এই বয়সটাতেই বাধা দেয়া উচিত। কারণ সিগারেট কোম্পানিগুলো তাদেরই টার্গেট করে।

তিনি বলেন, স্কুল কলেজ পড়ুয়া বা তরুণীদের মধ্য কত শতাংশ ধূমপানে আসক্ত তার নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে গ্রামের চেয়ে শহরে এখন বিশেষ করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তরুণীদের মধ্যে ধূমপানে আসক্তি বেড়েছে। বন্ধু বা কাছের কেউ, সে যার সঙ্গে সময় কাটায়- এমন কারো কাছ থেকেই শুরু। এরপর আস্তে আস্তে আসক্তি হয়ে যায়। তরুণীদের ধূমপানে আসক্তির জন্য শহরের জীবনযাত্রার মান অর্থাৎ আধুনিকতা ও আকাশ সংস্কৃতিকেও দায়ী করেন এই বিশেষজ্ঞ।

ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ধূমপানে আসক্তি হলে তা শুধু ধূমপানেই সীমাবন্ধ থাকে না। এটা থেকে তরুণীরা অন্য নেশার দিকে ধাবিত হয়। যেমন চরস, ইয়াবা, গাঁজা এগুলোর দিকে চলে যায়।

এটা খুবই উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই উদ্বেগেরে জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গা এই কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছি। কারণ এতে তো সে শুধু একা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তার পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময়ে যখন কেউ ধূমপান করে, তখন তো সে নিজে যেহেতু আয় করে না। তাই টাকার জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করে। অপরাধে জড়ায় বা পরিবারে চাপ দেয়, অশান্তি বাড়ায়।

ধূমপানের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্যান্সার হওয়ার খুবই আশঙ্কা থাকে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ফুসফুস, ব্রেস্ট, জরায়ুমুখ ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাদের চেহারার লাবণ্য কমে যাবে। যে বয়সে যে লাবণ্য থাকার কথা তা থাকবে না। চুলের উজ্জ্বল্য কমে যাবে। বয়সের আগেই বয়স্ক মনে হয়। বিয়ে হলে প্রজনন ক্ষমতা কমে যাবে।

তিনি বলেন, ধূমপানে হার্ট ডিজিজ হবে। যেগুলো সাধারণত মধ্যবয়সে হয়। ৫০ বা তারও বেশি বয়সে; সেগুলো দেখা যাবে অল্পবয়সেই হয়ে যাবে। আমরা দেখছি যে ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সে হার্ট ডিজিস হচ্ছে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হবে। মেধা কমে যাবে। সিগারেটের প্রথম দিকে কনসেন্টেশন বাড়ে কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে লোপ পায়। এর ফলে তার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। সে ভাবে, সে আগে ভালো ছিলো এখন। লেখাপড়া বা কাজে মন বসতো। কিন্তু একটা সময় মন না বসার কারণে সে হতাশ হবে।

তরুণীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়াকে সামাজিক অবক্ষয় বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমি বলবো তাদের প্রতি তাদের পরিবারের নজর কম। সন্তান কোথায় গেলো, কি করলো, কার সঙ্গে মিশলো-এই খবর রাখে না। ডিপ্রেশনের কারণে কিংবা যে সমাজে চলাচল করছে তার জন্য ধূমপান করছে।

তিনি বলেন, একটা সময়ে যখন এটা তার নেশা হয়ে যাবে, তখন সেই নেশার ফলে সে তো বিয়ের পরেও ধূমপান করবে। যখন তাদের সন্তান হবে। সেই সন্তানেও উপরও প্রভাব পড়বে। ধূমপায়ী মায়ের সন্তানরা বিকলঙ্গ বা বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শারীরিক ও মানসিকভাবে তাদের সন্তানের উপর প্রভাব পড়ে। এই প্রভাব জন্ম থেকে মৃত্যু পযর্ন্ত। আবার শিশুরা যখন দেখে তাদের মায়েরা ধূমপান করে তখন তাদের উপরও সেই প্রভাব পড়ে। পরিবারে অশান্তি শুরু হবে। হাসবেন্ড শাশুড়ি কিংবা বাসার লোকজন যখন জানবে যে বউ ধূমপান করে তখন একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি আরো বলেন, আগে দেখা যেত বয়স্ক নারীরা ধূমপান করতো। এখন কমবয়সী, উঠতি, হায়ার সোসাইট, বাইরে বিভিন্ন সোসাইটিতে চলাচল করে তাদের মধ্যে এখন ধূমপানের বেড়ে গেছে।

এতে উব্দেগ প্রকাশ করে এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা সামাজিক এবং পারিবারিক অবক্ষয়।ডিপ্রেশনের কারণে, কিংবা সে সোসাইটিতে চলে তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে, বা ফ্যাশানের কারণে তরুণীদের ধূমপানের মাত্রা বাড়ছে।

তিনি বলেন, পারিবারিক অবক্ষয় বলবো এ কারণে যে, যেহেতু তার পিতামাতা তার দিকে নজর দেয় না।পরিবারের উচিত তার সন্তানকে এটাসমেন্টে রাখা।

যারা ধূমপানে আসক্ত হয়েছেন, তাদের ধূমপান ছাড়ানো প্রসঙ্গে ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, তাদের জন্য কাউন্সিলিং হচ্ছে বড় ব্যাপার। জনসচেতনতা তো রয়েছেই। এছাড়া যেহেতু তারা টিনএজেই শুরু করে- টিনএজেই তাদের কাছে পযাপ্ত টাকা থাকে- নাস্তা করার জন্য, যাতায়াত ভাড়ার জন্য, বইপত্র কেনার জন্য। তাই টোবাকোর উপর যদি ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে ওই সময়ে সে অতো বেশি টাকা খরচ করতে পারবে না। তারা সেখান থেকেও দূরে থাকবে।

তবে খুলনার প্রভা হোমিও সেবাদানের চিকিৎসক ডা. প্রদীপ কুমার জানান, যারা ধূমপান করে তাদের যে নিকোটিন টানে, তা থেকে দূরে রাখার জন্য এক ধরনের হোমিও ঔষধ আছে। যা সেবন করলে সে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (১৫ বছর তদুর্ধ্ব) তামাক ব্যবহার করে। ২৩ দশমিক ২ শতাংশ ধূমপায়ী; ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী।

তামাক ব্যবহারের কারণে এক লাখ ৬০ হাজারের অধিক মানুষ প্রতিবছর (২০১৬) মৃত্যুবরণ করে, পুরুষদের মধ্যে এই মৃত্যুহার ২৬ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ১০ শতাংশ।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের আর্থিক ক্ষতির (অসুস্থতার চিকিৎসা এবং অকাল মৃত্যুর কারণে উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বাৎসরিক ১৫৮.৬ বিলিয়ন টাকা।

তামাক বিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা বলছে- তামাকের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো। কার্যকরভাবে কর বাড়ালে তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং সহজলভ্যতা হ্রাস পায়। উচ্চ মূল্য তরুণদের তামাক ব্যবহার শুরু নিরুৎসাহিত করে এবং বর্তমান ব্যবহারকারীদের তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করে।

প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, প্রস্তাবিত হারে কর বাড়ালে প্রায় ৬.৪২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী (৩.০৭ মিলিয়ন সিগারেট ধূমপায়ী এবং ৩.৩৫ মিলিয়ন বিড়ি ধূমপায়ী) ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে। সিগারেটের ব্যবহার ২.৭ শতাংশ এবং বিড়ির ব্যবহার ২.৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। দীর্ঘমেয়াদে ২.০১ মিলিয়ন বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে (১.০৮ মিলিয়ন সিগারেট ধূমপায়ী এবং ০.৯৪ মিলিয়ন বিড়ি ধূমপায়ী। ৭৫ থেকে ১০০ বিলিয়ন টাকা (অথবা জিডিপি’র ০.৪ শতাংশ) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে। এই অতিরিক্ত রাজস্ব তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে ব্যয় করা যেতে পারে।

সিগারেটের ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাবিত কর: নিম্নস্তরে করারোপের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভাজন তুলে দেয়া এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তরে (উচ্চস্তর) নিয়ে আসা; নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের সর্বনিম্ন মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং উচ্চস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং সকল ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা।

বিড়ি: বিড়ির ক্ষেত্রে ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার বিভাজন বিলুপ্ত করে ২৫ শলাকা বিড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির উপর ৬ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা।

ধোঁয়াবিহীন: ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল): এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা বিলুপ্ত করে সিগারেট ও বিড়ির ন্যায় খুচরা মূল্যের ভিত্তিতে করারোপ করা; প্রতি ২০ গ্রাম ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং প্রতি ২০ গ্রাম ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের উপর ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন