পিএনএস ডেস্ক: সারা বিশ্বজুড়ে বয়ে চলা প্রায় ৩০ লাখ নদী দ্রুততার সঙ্গে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এতে পানযোগ্য পানির সংকট থেকে শুরু করে আকম্মিক বন্যার ঝুঁকি সবকিছুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। নতুন এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং কম্পিউটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে গত ৩৫ বছরে পৃথিবীর প্রতিটি নদীর প্রতিদিনের পানি প্রবাহের মানচিত্র তৈরি করেছেন। এসব ফলাফল তাদের হতবাক করেছে।
গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর বৃহত্তম (ভাটিমুখী) নদীগুলোর প্রায় অর্ধেক বা ৪৪ শতাংশে প্রতি বছর পানি প্রবাহের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে। এই গবেষণাটি বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) বিখ্যাত সাময়িকী সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার প্রধান লেখক এবং সিঙ্কিনাটি ইউনিভার্সিটির হাইড্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডংমেই ফেং জানান, আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী কঙ্গো, চীনের ইয়াংজি এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্লাটা নদীর মতো বিশালাকার প্রমত্ত নদীগুলোর পানি প্রবাহ উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে। খবর সিএনএনের।
অন্যদিকে, পর্বত অঞ্চলের ছোট ছোট (উজানমুখী) নদীগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। সেগুলোর ১৭ শতাংশে পানির প্রবাহ বেড়ে গেছে।বরফ গলে যাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। গবেষণাটি নদীগুলোর এমন অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের কারণগুলো বিশ্লেষণ না করলেও বিজ্ঞানীদের মতে মানবসৃষ্ট কারণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে ব্যাপক মাত্রায় জলবায়ু পরিববর্তন হচ্ছে যা এর মূল কারণ। এর ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এবং বরফ গলে যাওয়ার মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
গবেষণার সহলেখক এবং ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক কলিন গ্লিসন বলেন, ‘আগের গবেষণাগুলো সাধারণত বড় নদীগুলোর পানি প্রবাহকে কেন্দ্র করে সীমিত ফলাফল দিতো। কিন্তু এই গবেষণায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীদের 'সবকিছুকে একসঙ্গে দেখার' সুযোগ এনে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি হয়তো স্থানীয় পর্যায়ে নির্ভুল ফলাফল দিতে না পারলেও আমাদের ধারণা এটি নদীর প্রবাহের সবচেয়ে নির্ভুল মানচিত্র।’ গ্লিসনের মতে, ‘বিশ্বের নদীগুলো আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক ভিন্ন। কিছু নদী বছরে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পরিবর্তনের মুখোমুখী হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তন।’
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বিশালাকার ভাটিমুখী নদীগুলোর পানি প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সেখান থেকে পানযোগ্য পানি, সেচের জন্য পানি এবং পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি কমে যাচ্ছে। নদীর ধীর স্রোতের মানে হচ্ছে এর পলি বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া। এই পলি ডেল্টা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যা সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়।
অন্যদিকে, ছোট নদীগুলোতে দ্রুত প্রবাহ এবং স্রোত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বরফ ও তুষার গলে যাওয়া অন্যতম কারণ। এটি মাছের জন্য পুষ্টি সরবরাহ এবং তাদের অভিবাসনে সহায়তা করতে পারে। তবে দ্রুত প্রবাহ বা খড়স্রোত আবার অনেক সমস্যাও তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ, হিমালয় অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বেশি পলি নিচে নেমে আসায় অবকাঠামোতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩৫ বছরে ছোট (উজানমুখী) নদীগুলোর কারণে ভয়াবহ বন্যার সংখ্যা ৪২ শতাংশ বেড়েছে।
রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক হান্না ক্লোক, যিনি এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তিনি বলেন, ‘ছোট নদীগুলোর ওপর বিস্তৃত গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'সবচেয়ে মারাত্মক বন্যাগুলো সবসময় বড় নদীতে ঘটে না। এটি এমন নদীতে ঘটে যা সাধারণত শুকনো থাকে বা হঠাৎ প্রমত্ত হয়ে যায় এবং মানুষ, গাড়ি এবং ভবন ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’
ক্লোক আরও বলেন, ‘মানুষের কর্মকাণ্ড এবং পানিচক্রের পরিবর্তনের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। নদীগুলোকে রক্ষার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো, ইতোমধ্যে ঘটতে থাকা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে নির্মাণকাজের মতো প্রভাব মোকাবিলার পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘নদীগুলো হলো পৃথিবীর রক্তনালী। নদীর প্রবাহে পরিবর্তন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। নদীগুলো গতিশীল এবং গোটা পৃথিবীর জন্য অনন্য শক্তি। মানুষের কখনোই নদীকে অবহেলা করা বা তাদের দেয়া অফুরন্ত সম্পদ অহেতুকভাবে বিনষ্ট করা উচিত হবে না,’ ক্লোক যোগ করেন।
পিএনএস/রাশেদুল আলম
বিশ্বের ৩০ লাখ নদী নিয়ে ৩৫ বছরের গবেষণা প্রকাশ
13-12-2024 02:43PM