ডিসি নিয়ে নজিরবিহীন হট্টগোল, দুই প্রজ্ঞাপন বাতিল হচ্ছে

  10-09-2024 11:01PM

পিএনএস ডেস্ক : গত দুই দিনে দেশের ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন এ পদায়নে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে সচিবালয়ে হট্টগোল করেছেন উপসচিব পর্যায়ের এক দল কর্মকর্তা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের কক্ষে গিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে ‘এককভাবে ডিসি পদায়নের তালিকা তৈরির’ অভিযোগ তোলেন।

বিএনপি-জামায়াতপন্থি ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নতুন পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই হাসিনা সরকারের ফিটলিস্টের কর্মকর্তা ও সুবিধাভোগী। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এ কর্মকর্তাদের ডিসি নিয়োগ করা হয়েছে বলে তাদের দাবি। এ নিয়ে দিনভর সচিবালয়ে চলে হট্টগোল।

পরে কর্মকর্তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গত দুই দিনে জারি করা ডিসি নিয়োগের দুই প্রজ্ঞাপন বাতিল করার দাবি জানান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন তাদের দাবির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব গতরাতেই বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারকে জানিয়েছেন। প্রজ্ঞাপন দুটি বাতিল করে নতুনভাবে পদায়ন হতে পারে।

নাম দেখতে না পেয়ে হট্টগোল

গতকাল ৩৪ জেলায় জেলা প্রশাসক দেওয়ার পর প্রজ্ঞাপনে নিজেদের নাম দেখতে না পেয়ে ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের এক দল উপসচিব বিক্ষুব্ধ হন। কর্মকর্তারা জানান, সোমবার ২৫ জনকে ডিসি পদায়ন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেখানে তিনজন ছিলেন বঞ্চিত কর্মকর্তা। সিলেটের ডিসিসহ বেশির ভাগ ডিসিই হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী ও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর মধ্যেই গতকাল দুপুরে আরও ৩৪ জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুপুরে বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা এপিডি অনু বিভাগের দুই কর্মকর্তা ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ এবং কে এম আলী আযমের কক্ষে প্রবেশ করে জানতে চান– কীভাবে এ ধরনের ব্যক্তিদের ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হলো? এ সময় যুগ্ম সচিব আলী আযম উত্তেজিত হয়ে উঠলে বঞ্চিতরা ক্ষেপে যান। শুরু হয় হইচই, হট্টগোল। এনএসআইর একজন কর্মকর্তা মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করতে গেলে ফোন ছিনিয়ে নেন বঞ্চিতরা। এ সময় ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয়। পরে আলী আযম খবর দিলে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা সেখানে যান।

কর্মকর্তারা দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। ডিসি হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যাশা ছিল, কারণ তারা চাকরিজীবনে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তারা যুগ্ম সচিবের কাছে জানতে চান, কেন তিনি এককভাবে তালিকা তৈরি করলেন? কেন মেধা, যোগ্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে তালিকা করা হলো না? কীভাবে গত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা ডিসি পদে পদায়ন পেলেন?

জবাবে কে এম আলী আযম বলার চেষ্টা করেন, তিনি প্রস্তাব তৈরি করেননি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও একজন উপদেষ্টার নাম উচ্চারণ করে তিনি বলেন, তারাই সব কিছু চূড়ান্ত করেছেন।
এ পর্যায়ে কর্মকর্তারা তাঁকে বলেন, তাহলে আপনি আমাদের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চলুন। আপনি তাঁর সামনে বলুন, আপনি কোনো প্রস্তাব দেননি। তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানালে উপসচিবরা বলেন, তারা নিশ্চিত হয়েছেন কে এম আলী আযমই এককভাবে তালিকা তৈরি করেছেন।
বেলা ৩টার দিকে বঞ্চিতরা দুই কর্মকর্তাকে কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। তিনি চলে গেলে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কর্মকর্তারা দুই যুগ্ম সচিবকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কক্ষে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। এ সময় আলী আযম টয়লেটে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় ২ ঘণ্টা পর সিনিয়র কর্মকর্তারা তাঁকে বের করেন। পরে দুই কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে বিকেল ৫টার দিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ‘বঞ্চিতরা’। তারা বঞ্চিতদের দাবির বিষয়টি সরকারকে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

ভিডিও ফুটেজ

যুগ্ম সচিবের রুমে হট্টগোলের একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায়, নতুন পদায়ন পাওয়া কয়েকজন ডিসির সঙ্গে পদায়ন না পাওয়া উপসচিবরা হট্টগোলে জড়িয়ে পড়েছেন। ওই সময় সেখানে ছিলেন উপসচিব নজরুল, সাইফুল, নুরুল, শাহীন, রেবেকা, বদরুলসহ ২৫-৩০ জন।

জনপ্রশাসনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন উপসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুরো তালিকা এককভাবে যুগ্ম সচিব আলী আযম তৈরি করেছেন। জনপ্রশাসন সচিব নতুন। তিনি সব কর্মকর্তাকে এখনও চেনেন না। আর মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার জনপ্রশাসনের পাঠানো তালিকার ওপর ভরসা রেখেছিলেন। তারা বুঝতেও পারেননি গত সরকারের আমলে বঞ্চিতরা এ সরকারের আমলে এভাবে আরেক দফা বঞ্চিত হবেন।
এসব বিষয়ে কে এম আলী আযমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলেও তা রিসিভ হয়নি।

নতুন ডিসি হলেন যারা

গতকাল ৩৪ জনকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আগের দিন সোমবার ২৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে গত ২০ আগস্ট এসব জেলার ডিসি প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

গতকাল ডিসি হিসেবে পদায়ন পাওয়াদের মধ্যে অর্থ বিভাগের উপসচিব মনোয়ার হোসেন মোল্লাকে মানিকগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. সাবেত আলীকে টাঙ্গাইল, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদারকে সিরাজগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তোশাখানা ইউনিটের পরিচালক (উপসচিব) মোস্তাক আহমেদকে সাতক্ষীরা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশরাফুর রহমানকে ঝালকাঠি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খানকে পিরোজপুর, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামকে চুয়াডাঙ্গা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব বনানী বিশ্বাসকে নেত্রকোনা, আরপিএটিসির উপপরিচালক মনোয়ারা বেগমকে রাজবাড়ী, ওয়াক্‌ফ প্রশাসকের কার্যালয়ের উপ-ওয়াক্‌ফ প্রশাসক হাছিনা বেগমকে জামালপুরের ডিসি করা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আব্দুস সামাদকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব সুফিয়া আক্তার রুমীকে লক্ষ্মীপুর, জয়িতা ফাউন্ডেশনের পরিচালক (উপসচিব) মোছা. ইয়াসমিন আক্তারকে মাদারীপুর, জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব ফৌজিয়া খানকে কিশোরগঞ্জ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহবুবুর রহমানকে রাজশাহী, নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের পরিচালক (উপসচিব) মোহাম্মদ দিদারুল আলমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব ফাতেমা তুল জান্নাতকে মুন্সীগঞ্জ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. আব্দুল আজিজকে শরীয়তপুর, অর্থ বিভাগের উপসচিব আহমেদ কামরুল হাসানকে বাগেরহাট, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিরীক্ষা কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনকে পটুয়াখালী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে সুনামগঞ্জ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপসচিব মো. আজাদ জাহানকে ভোলা, খুলনা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক (উপসচিব) সিফাত মেহনাজকে মেহেরপুর, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামানকে পঞ্চগড়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (উপসচিব) মো. আজহারুল ইসলামকে যশোর, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমকে বরগুনা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানকে নড়াইলের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গত দু’দিনে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে শেরপুরের ডিসি তরফদার মাহমুদুর রহমান সাবেক আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব মইনুল কবিরের পিএস ছিলেন। ফরিদপুরের ডিসি কামরুল হাসান মোল্লা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাভারের ইউএনও ছিলেন। তিনি ঢাকার ডিসি হিসেবে পদায়ন পাওয়া তানভীর আহমেদের ভগ্নিপতি। নাটোরের ডিসি রাজীব কুমার সরকারের শ্বশুর যতীন সরকার। তিনি ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। জয়পুরহাটের নবনিযুক্ত ডিসি মো. সাইদুজ্জামান টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের ইউএনও থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারি অফিশিয়াল বনভোজনের আয়োজন করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। আর চাঁদপুরের ডিসি মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিনকে গত ২৭ মার্চ রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে পদায়ন করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

সিলেটের ডিসি প্রত্যাহার

সিলেটের ডিসি পি কে এম এনামুল করিমকে নিয়োগ দেওয়ার পরদিনই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। গতকাল সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব শের মাহবুব মুরাদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ফেনী শহরের এসএসকে সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানকালে এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে চড় মেরেছিলেন তৎকালীন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পি কে এম এনামুল করিম। সেই ঘটনায় বিব্রত হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন