পিএনএস ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও নেপালে কংগ্রেস পার্টির মতো বিশ্বস্ত অংশীদারদের ক্ষমতায় রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের এই কাজে ঝুঁকি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। ওয়াশিংটনের ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের গবেষক নিলান্তি সামারানায়াকের কথায়, ভারত যখন এই ছোট দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলে, তখনই ক্ষোভ তৈরি হয়। বিরোধী ও জনসাধারণ বিষয়গুলো মনে রাখে।
ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছে মালদ্বীপে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে মোহাম্মদ মুইজ্জু মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ফলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে উঠেপড়ে লাগে ভারতের সরকার ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)।
মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এক কড়া বক্তৃতায় তার দেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের অপসারণের ঘোষণা দেন। ভারতের পরিবর্তে তিনি ভারতেরই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেন, এমনকি বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি সই করারও চেষ্টা করেন।
সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্রের বরাতে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর এজেন্টরা গোপনে মালদ্বীপের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন মুইজ্জুকে ক্ষমতাচ্যুত করার সম্ভাবনা নিয়ে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন তারা।
এ সংক্রান্ত একটি গোপন নথি হাতে পেয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। ‘ডেমোক্রেটিক রিনিউয়াল ইনিশিয়েটিভ’ (গণতান্ত্রিক নবায়ন উদ্যোগ) শীর্ষক ওই নথি থেকে জানা যায়, মালদ্বীপের বিরোধী রাজনীতিবিদরা ৪০ জন সংসদ সদস্যকে ঘুস দেওয়ার প্রস্তাব দেন, যাতে তারা মুইজ্জুকে অভিশংসিত করার পক্ষে ভোট দেন। এসব সংসদ সদস্যের মধ্যে মুইজ্জুর দলের নেতারাও ছিলেন।
এসময় ১০ জন জ্যেষ্ঠ সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং তিনটি শক্তিশালী অপরাধী গ্যাংকেও অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যাতে মুইজ্জুর অপসারণ নিশ্চিত করা যায়। এভাবে বিভিন্ন পক্ষকে অর্থ দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা ৮ কোটি ৭০ লাখ মালদ্বীপিয়ান রুফিয়া বা ৬০ লাখ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন ষড়যন্ত্রকারীরা, যা তারা ভারতের কাছ থেকে পাওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস ধরে গোপন আলোচনার পরেও ষড়যন্ত্রকারীরা মুইজ্জুকে অপসারণের জন্য পর্যাপ্ত ভোট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। ভারতও এই উদ্যোগে আর সামনে এগোয়নি, তারা অর্থ দেওয়ার থেকেও বিরত থাকে।
রাজনীতিতে ভারতীয় হস্তক্ষেপ
মালদ্বীপের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) ওপর ভারত কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, সে সম্পর্কে জানিয়েছেন মালদ্বীপ ও ভারতের দুই ডজনের বেশি কর্মকর্তা। তাদের অনেকেই গোপনীয়তার কারণে নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানান।
তারা বলেন, বছরের পর বছর ধরে ভারত এমডিপির নেতা ও দলটির প্রার্থী নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছে। ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় মুইজ্জু যখন ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন এবং ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান তোলেন, তখন তার বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য ভারত থেকে নির্বাচনী বিশ্লেষক ও প্রচারণা কর্মী পাঠানো হয়। তারা এমডিপির প্রচারণায় সহায়তা করেন, যা কিছু মালদ্বীপিয়ান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
অভিশংসনের ষড়যন্ত্র
মুইজ্জু পরিবারের এক উপদেষ্টা জানান, মুইজ্জু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ওয়াশিংটনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের এক শীর্ষ গোয়েন্দা (র) কর্মকর্তা দুইজন ভারতীয় মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে মুইজ্জুকে অপসারণের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। মালদ্বীপে এদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল।
এর মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারী হলেন শিরিশ থোরাট, যিনি একজন সাবেক ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা। অন্যজন হলেন সাভিও রদ্রিগেস, যিনি ভারতের গোয়া রাজ্যের একজন প্রকাশক ও ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক মুখপাত্র। মুইজ্জু পরিবারের উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে র কর্মকর্তা ও থোরাটের ফোন কল এবং বৈঠকে নজরদারির রেকর্ড হস্তান্তর করেছেন। কিন্তু সেগুলো কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেননি।
ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে থোরাট এবং রদ্রিগেস উভয়েই মুইজ্জুকে অপসারণের পরিকল্পনার তথ্যটি নিশ্চিত করেন। কিন্তু তারা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কাজ করছেন কি না তা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন। ভারত কতটা গুরুত্ব সহকারে মুইজ্জুকে অপসারণের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছিল বা পরিকল্পনাটি নয়াদিল্লির শীর্ষ কর্মকর্তারা অনুমোদন করেছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মুইজ্জুর যোগাযোগমন্ত্রী ইব্রাহিম খালিলও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
পিএনএস/রাশেদুল আলম
মালদ্বীপ-বাংলাদেশে বিশ্বস্তদের ক্ষমতায় রাখতে ভারতের গভীর ষড়যন্ত্র
31-12-2024 10:35PM