প্রকাশ্যে আসছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ

  10-11-2024 12:27AM

পিএনএস ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানের পর রাজনীতির মাঠে হঠাৎ আলোচনায় এসেছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন। তেমন কোনো কর্মতৎপরতা না থাকলেও সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। এখন সংগঠনটির নেপথ্যে কারা কাজ করছেন, তা নিয়ে জোরেশোরেই প্রশ্ন উঠেছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করা সংগঠনটির শেকড়ে রয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে তিনি খোমেনি এহসান নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনটি পরিচালনা করেন। সংগঠনটির মূল উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা পালনকারী খোমেনি এহসানও থাকেন পর্দার আড়ালে। এমনিতেই তিনি জাপানে অবস্থান করেন। সংগঠনটি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রকাশ্যে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংগঠনটির পেছনে থাকা মূল ব্যক্তি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরপর মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে নতুন কোনো শক্তি তৈরির লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন, যা পরবর্তীতে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ নামে রূপ পায়। তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও রয়েছে। সংগঠনটির কর্তারা দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজনীতির মাঠে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে চান। তারা দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা চান। এজন্য সময় প্রয়োজন। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করে দীর্ঘমেয়াদি একটি সরকার হোক- এজন্য সংগঠনটির নেতারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কে এই খোমেনি এহসান:
জাতীয় বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে নাম আসা খোমেনি এহসান জাপানে থাকেন। তার জন্ম শরীয়তপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) পড়তেন। এক সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার সমসাময়িক ঢাবির শিক্ষার্থীরা তাকে শিবিরের বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে দেখেছেন। ১/১১ এর সময় এই খোমেনি বিএনপির হয়ে কাজ করেছেন। তখন থেকে তিনি বিএনপি মনোভাব ধারণও করতেন। যদিও ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এর ফলে আওয়ামী-বিএনপির বাইরে নতুন কোনো শক্তি তৈরিতে কাজ করছেন তিনি।

২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নির্যাতন প্রতিরোধ ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন খোমেনি। ছাত্রজীবনে তিনি দৈনিক নয়াদিগন্তের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্রজীবন শেষ করে দৈনিক আমার দেশ, যুগান্তরসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে কাজও করেছেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। জুলাই বিপ্লবে তার অবদান ছিল। যে কোনো সময় তিনি দেশে এসে নতুন দলটির হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছে।

দেশে তার ভাই, ছাত্রজীবনের অনুসারী ও সতীর্থরা সরাসরি কাজ করছেন এ সংগঠনে। মূল সংগঠনে হাসান আরিফ নামের একজন সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৭-২০০৮ সেশনে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হওয়া আরিফ ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি ও ই-কমার্স সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। কয়েক মাস আগে চাকরি ছেড়ে আমদানি-রফতানির ব্যবসা শুরু করেন হাসান।

এক নজরে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ:
মূল দল জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ পুরোপুরি গঠিত না হলেও তাদের ছাত্র সংগঠন গঠিত হয়েছে। পেশাজীবী পরিষদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন উইং গঠন কাজও চলমান। জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের আনুষ্ঠানিক কমিটি না থাকলেও বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি আছে। তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি নিয়েও কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে ‘সিপাহী-জনতার ঐক্যে রাষ্ট্র পুনর্গঠন: জাতীয় নিরাপত্তায় নতুন প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভা করেছে।

জাতীয় বিপ্লবী পরিষদে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছে দলটি। গুগল থাকা ফরমে তারা বলেছে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। ২০২৪ এর আগস্ট বিপ্লবে সম্পৃক্ত বিপ্লবীদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ও ক্ষমতাসীন করতে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যেন বিপ্লবীরা রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কার এবং দলমত নির্বিশেষ জাতীয় সমঝোতা কায়েম করতে সক্ষম হয়। বিপ্লবীরা রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বস্তর থেকে প্রতিবিপ্লবীদের উৎখাত করবে এবং বিপ্লবী সরকার গঠন করবে। বিপ্লবীরা জনগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব কায়েম করবে এবং গণশত্রুদের বিচারের মধ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে সব বৈরিতার অবসান ঘটাবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহর প্রতি আমাদের সকল দায়বদ্ধতা নিবেদিত। আমরা জনগণের বিপ্লবের হেফাজতকারী। আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হেফাজতের তৌফিক কামনা করি। জাতীয় বিপ্লবী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছুকরা নিচের ফরমটি পূরণ করে নিবন্ধিত হতে পারবেন।

বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের ঢাবি শাখা গঠন:
জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের ছাত্র সংগঠনের নাম বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ। এরই মধ্যে এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়েছে। আহ্বায়ক আবদুল ওয়াহেদ ও সদস্য সচিব ফজলুর রহমান। সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক হিসেবে আছেন সানোয়ারা খাতুন।

জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের ছয় দফা প্রস্তাবনা:
৭ নভেম্বরের অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র পুনর্গঠনে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা কাঠামোতে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানানোসহ ছয় দফা প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। প্রথম দফায়- সেনাবাহিনীকে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি শাসিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সর্বাত্মক সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে বলা হয়। দ্বিতীয় দফায়- একটি শক্তিশালী জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করতে বলা হয়, যার চেয়ারম্যান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভাইস চেয়ারম্যান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান হবেন। প্রস্তাবনা অনুসারে, এই পরিষদে প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধান, পুলিশ প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ও নাগরিকরাও অন্তর্ভুক্ত হবেন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের আলোকে পুরাতন সংবিধান বাতিল এবং ফ্যাসিবাদী দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করবে।

তৃতীয় দফায়- নতুন সংবিধান প্রণয়নে দ্রুত গণপরিষদ গঠন ও নির্বাচন পরিচালনা এবং পরবর্তীতে দ্রুত সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা প্রদান তত্ত্বাবধান করার প্রস্তাব রাখা হয়।

চতুর্থ দফায়- দেশের আর্থিক খাতের নিরাপত্তা তথা ব্যাংক, স্টকএক্সচেঞ্জ, আমদানি-রফতানির লেনদেন সামরিক বাহিনীর মনিটরিং ও তত্ত্বাবধানে হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। পঞ্চম দফায়- দেশের সব উপজেলা পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সেনা মোতায়েন করে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি হামলাসহ জননিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানানো হয়। এক্ষেত্রে পুলিশ, র্যা ব ও বিজিবির সহায়তা নিতে সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দেওয়া হয়। ষষ্ঠ দফায়- সেনাবাহিনী, জনপ্রশাসনসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের দোসর, দুর্নীতিবাজ ও দেশবিরোধীদের চিহ্নিত করে তাদের শূন্যপদে সাবেক দেশপ্রেমিক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান করতে প্রস্তাব রাখা হয়।

এ বিষয়ে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সমন্বয়ক হাসান আরিফ বলেন, আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। কিন্তু নেতৃত্বে ছিলাম না। আমরা অর্থ, পরামর্শ ও সমর্থন দিয়ে তাদের পাশে ছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আমাদের ছোটভাই-বন্ধু। আমরা আমাদের চিন্তা থেকে রাজনৈতিক দল করছি। আমাদের ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ। আমাদের মূল সংগঠন গোছাচ্ছি। এখনো কমিটি হয়নি। তবে ছাত্র সংগঠনের কমিটি হয়েছে।

দলটির নিবন্ধন করা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নিবন্ধনের জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। কিছু শর্তও আছে। সেগুলো আগে পূরণ করতে হবে। ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জঞ্জাল এবং অসহিষ্ণুতাকে বিদায় করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চাই।

বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ গঠন করা হয়েছে। প্রধান প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং ইসলামী ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রিয়াশীল রয়েছে। এসব সংগঠনকে ছাপিয়ে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদই হয়ে উঠবে বাংলাদেশের প্রধান ছাত্র সংগঠন এবং মেধাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রধান ভ্যানগার্ড।

সার্বিক বিষয়ে সংগঠনটির মূল ভূমিকায় থাকা খোমেনী ইহসান গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিশ্ব নেতৃত্বকে সম্মান করি। তাদের শিক্ষা ও সহযোগিতা নিয়ে আমাদের দেশ গড়তে চাই। আমাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে অস্পষ্টতা নেই। মূলত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে এটিই আমাদের নেতাকর্মীরা আত্মস্থ করার চেষ্টা করছেন। তারা রাজপথ থেকে সংসদে ব্যবহারিকভাবে অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাবে। মূলত আমরা ভূরাজনীতি ও ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের রাজনীতি করতে চাই৷

পিএনএস/রাশেদুল আলম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন