পিএনএস ( আকিজ মাহমুদ ) : শায়েস্তা খানের সময় নাকি এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। কিন্তু সেই আট মণ চাল কেনার লোক খুব কমই পাওয়া যেত। ইতিহাস বলে এই বাংলা সবসময় প্রাচুর্যে ভরা ছিল। সেই প্রাচুর্যের লোভে বার বার ভিনদেশি শত্রুরা এই দেশে আক্রমণ করতো।
বাংলার সবই ছিল, খাওয়ার জন্য গোলা ভরা ধান ছিল, নদীতে প্রচুর মাছ ছিল। কি ছিল না বাংলায়! আজও বাংলায় ৩০ হাজার কোটি টাকায় পদ্মা সেতু, হাজার হাজার কোটি টাকায় মেট্রোরেল, কোটি কোটি টাকায় রাস্তাঘাট, অবকাঠামো উন্নয়ন সবই হয়। আজকের এই দিনে ৩০০ বছর পূর্বের ঘটনার সাথে বর্তমান বাংলাদেশের তুলনা করবো না। আজ থেকে ১০ বছর আগেও দেশের মানুষের বিশ্বাস হতো না যে তাদের টাকাতেও পদ্মার ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু এই দশ বছরে দেশ কতো কিছুই না দেখলো! পরিবর্তন আর উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ১০ বছর আগের গরিব বাংলাদেশ আজ মধ্যবিত্ত দেশের কাতারে।
এইতো ২০১১ সালের কথা, দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয় এর প্রধান অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক। তাদের অনুরোধে কানাডার পুলিশ সে দেশের দুই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনজি ও লাভালিন ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ২০১২ সালে কানাডার আদালতে এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে দুর্নীতির ঘটনায় এসএনসিকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ তখনও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়নি। গণমাধ্যম থেকে চা স্টল সবখানেই এ নিয়ে যথারীতি তুলকালাম বেঁধে যায়। সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় সরকার দলীয় একজন মন্ত্রী। কিন্তু এরপর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময়ে যখন ঘোষণা দিলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর সব কাজ সমাপ্ত করা হবে তখন অনেক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এমনকি সাধারণ নাগরিকরাও এটিকে যথারীতি অবাস্তব কল্পনা বলে উপহাস করে। সরকার বিরোধী সংগঠনের অনেকে আবার এটিকে জাতির সঙ্গে তামাশা বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু প্রায় ১০ বছর আগের এসব ঘটনায় মোটেও বিচলিত হয়নি মুজিব কন্যা বরং তার দৃঢ় মনোবল তার সিদ্ধান্তকে কখনোই পরবর্তীতে জাতির কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন করেনি। দেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন অনেক বিশাল, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আদলে গড়া।
দেশকে ইতোমধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছেন, দেশের মানুষ আজ না খেয়ে অনাহারে থাকে না। দেশের মানুষকে তিনি দেখিয়েছেন দেশের টাকাতেও দেশের বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ পুরোটুকুই দৃশ্যমান। সেতুর ৪১টি স্প্যান বসানো ছিল যেন এদেশের কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরনের এক একটি পর্যায়। আর পুরো স্বপ্নটি আজ দৃশ্যমান ৪২টি পিলারের ওপর। এক সময় পুরো দেশে সমালোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প আজ সাড়া দেশের মানুষের অবাস্তব কল্পনার বাস্তবায়ন।
দেশে উত্তর বঙ্গের সাথে পুরো দেশের সংযোগ ঘটাতে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হয়। এই একটি সেতু পুরো উত্তর বঙ্গের অর্থনীতির ছবিই পাল্টে দেয়। এরই প্রেক্ষিতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানীর সংযোগ ঘটাতে প্রয়োজন পরে পদ্মা নদীর ওপর আরো একটি সেতু নির্মাণের। বর্তমান পদ্মা সেতুর প্রতীক্ষায় আছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, যশোর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও রাজবাড়িসহ ১৯ জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ।
সেতুহীন এই পদ্মা নদীর জন্য একজন মানুষকে কতটুকু দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজ অভিজ্ঞতা থেকে স্বীকার করেছেন, তিনিও একজন ভুক্তভোগী। নদী পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় দু’পাশের মানুষদের। লঞ্চ,নৌকা ডুবির ঘটনাকে সঙ্গী করেই বার বার সেই একই পথ ধরতে হয় নদীর দু’পাশের মানুষকে। পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলে মানুষের দুর্ভোগের যেমন লাঘব হবে, তেমনি শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে যাবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থ সহায়তা থেকে সরে দাঁড়ালে দুর্নীতির অভিযোগে তাদেরই অনুরোধে মামলা হয় কানাডার আদালতে। বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার জবাব এসেছিল কানাডার ওই আদালত থেকেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পে আলোচিত সেই দুর্নীতির মামলাকে ‘অনুমানভিত্তিক’ ও ‘গুজব’ বলে উল্লেখ করেছিল কানাডার আদালতটি। একই সাথে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি’কেও ‘নির্দোষ’ বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ শুরু থেকেই পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও সমালোচনার জন্ম হয় তা ছিল সবটুকুই বানোয়াট।
আজ যখন পদ্মার দুপাশ থেকেই স্বপ্নের সেতুটি জনমানুষের চোখের সামনে দৃশ্যমান, তখন বিশ্বব্যাংক ও কতিপয় স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর তৎপরতা ম্লান হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, পদ্মা সেতুর এই পুরো প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিশ্ব ব্যাংকের তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ ও প্রথম থেকেই যারা পদ্মা সেতু নির্মাণকে ব্যহত করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে প্রকল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের জন্য এই দৃশ্যমান পদ্মাসেতু একটি উচিত জবাব বৈ কি! সেই সাথে বিশ্ববাসীকে একটি বার্তা দেওয়া গেলো, আমরাও পারি আমাদের টাকায় খরস্রোতা নদীর ওপর ৬.১৫ কিলোমিটারের একটি সেতু নির্মাণ করতে।
পরিশেষে, একটি যোগ্য নেতৃত্বই পারে একটি জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে, যোগ্য নেতৃত্ব দ্বারা একটি জাতি বা দেশ আলোর পথ আবিষ্কার করতে পারে। সম্প্রতিক দেশে যে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে, তা যোগ্য নেতৃত্বেরই ফসল। বারবার ঘাত-প্রতিঘাতে ঘায়েল হয়ে আসা দেশের সমৃদ্ধি ঘটুক বারবার এমন যোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরেই, দেশ এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পিএনএস/জে এ
কোটি স্বপ্নের জোড়া লাগালো একটি স্প্যান
12-12-2020 08:29PM