পিএনএস ডেস্ক: যে কোন রাজনৈতিক দলের সম্মেলন হলে রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে আগ্রহ স্বাভাবিক। আর মূলধারার রাজনৈতিক দলের সম্মেলন হলে সে উৎসাহ অধিক। এই আগ্রহের একটি বড় কারণ, দলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব কেমন হবে সেটা নিয়ে। কারণ একটি দলের নেতৃত্বের দক্ষতা, যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, ক্যারিশমার উপর নির্ভর করে দলের ভবিষ্যত ক্ষমতায়ন, অবস্থা ও জনস্বার্থের আন্দোলন-সংগ্রাম। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো পর্যন্ত অনেকটাই ব্যক্তিনেতা ও পরিবারকেন্দ্রীক। এ অবস্থার পরিবর্তনের আলাপ-আকাঙ্খা দীর্ঘদিনের হলেও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি ঘটেনি।
বাংলাদেশের নেতানেত্রীরা মূলনেতৃত্বে কে কতদিন আছেন?
বাংলাদেশের নেতৃত্বের বয়স নিয়ে ২০১৪ সালের ‘কালের কণ্ঠ’র একটি রিপোর্ট চোখে পড়লো। সেখানে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের বয়সের একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের প্রকাশিত রিপোর্টের তথ্যকে ২০২২ সালের হাল নাগাদ করতে- আমি এর সাথে ৭ বছর বাড়তি যুক্ত করে’ হিসাবটা তুলে ধরছি।
৩৬ বছর আহ্বায়ক এবং পাঁচ বছর সাধারণ সম্পাদক, সব মিলিয়ে গত ৪১ বছর ধরে বাসদের নেতৃত্বে ছিলেন খালেকুজ্জামান। সময়ের হিসাবে তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার চেয়ে এক বছর এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চেয়ে চার বছর বেশি সময় ধরে একটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ২৮ বছর, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ৩৭ বছর, জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব ৩৭ বছর, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ৩৫ বছর, সিপিবি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ২৮ বছর, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া ৩৪ বছর ধরে নিজ নিজ দলের নেতৃত্বে আছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের গড় বয়স কত?
রাজনীতিতে তারুণ্যের কথা বলা হলেও তার অবস্থা খুবই করুণ। একাদশ জাতীয় সংসদের পর মন্ত্রিসভার সদস্যদের বয়স পর্যালোচনা করে দেখা যায় সেখানে তরুণ-যুবকদের প্রাধান্য নেই।
২০২১ সালে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত তথ্যমতে, বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের গড় বয়স ৬৪ বছর, ৫০ এর কম বয়সি মন্ত্রী ৯ জন। পূর্ণমন্ত্রী ২৪ জন যাদের বয়সের গড় ৬৪ বছর। প্রতিমন্ত্রী ১৯ জন যাদের গড় বয়স ৫৬.৫ বছর। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্যদের গড় বয়স ছিল ৪৯ বছর।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৬০০ প্রার্থীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ৩০ বছরের নিচে মাত্র ৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ৬০ বছরের উপরে ২৯০ জন। এমনকি এই ৬০০ প্রার্থীর গড় বয়স ছিল ৬৩ বছর।
বাংলাদেশের জাতীয় যুবনীতি অনুসারে ১৮ থেকে ৩৫ বছরে ছেলেমেয়েদের যুব হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসেবে যুবকদের মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র ৩ জন।
রাজনীতিকদের অবসরে যাবার সংস্কৃতি নেই
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের অবসরে যাবার কোন সংস্কৃতি ও ধারনা নেই। তাঁরা আমৃত্যু তাদের পদ-পদবি-নেতৃত্ব-কর্তৃত্বে আকড়ে থাকেন। এমনকি আমলারা অবসরের পর রাজনীতি করেন। যে কারণে, দলে নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে না, তার বিকাশ ঘটে না, ঘটতে দেয়া হয় না। প্রায় সব দলেই নেতৃত্বের ক্রন্দলে ভাঙ্গন-বিরোধ, বহিষ্কার ও দল-উপদল হয়েছে। অথচ দল ও পদ থেকে অবসর নেয়া- সভ্য ও উন্নত দেশগুলোতে এটা একটা কমন প্রাকটিস।
রাজনীতিকরা তাদের ব্যর্থতা দেখেন না
কোন রাজনৈতিক দলের নেতা যদি ভোট না পান, নির্বাচিত না হন, ক্ষমতায় না যেতে পারেন, নেতৃত্ব গড়ে তুলতে না পারেন, দলকে বিস্তৃত-বিকশিত করতে না পারেন, দলের গুণ-মান-শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে কোনভাবেই তারা তাদের নিজেদের দায়, ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা দেখেন না। এসব ক্ষেত্রে নিজেদের দায়-ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করার সংস্কৃতিও আমাদের দেশে নেই। যে কারণে বিকল্প নেতৃত্ব এ অবস্থা পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি বা এগিয়ে আসতে দেয়া হয়নি। এবং যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা অনেক দল শক্তিহীন, ক্ষয়িঞ্চু ধারায় নেতৃত্বনির্ভর হয়ে টিকে আছে।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের অবস্থা
১। দল-সংগঠনে যারা সম্ভবনাময়ী, মূল নেতৃত্ব পদ আকড়ে থাকায়, সম্ভবনাসময় সে সব নেতৃত্ব সামনে আসতে পারছে না
২। পূর্বের ন্যায় দেশে জনবান্ধব, গ্রহণযোগ্য, ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ তলানীতে অবস্থান করছে।
৩। নেতৃত্ব অর্জনের ধারা-প্রবণতা-ব্যবস্থায় পরিবর্তন; পরিবার, অর্থ-ক্ষমতা-প্রভাব, তোষামোদি, চাটুকারিতা, আনুগত্য ইত্যাদি বিষয়গুলোকে এর গুনাবলীর অংশ করা হয়েছে।
৪। নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব, বলাবক্তব্য, জানাশোনা, লেখাপড়ার মান, আদপকায়দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৫। আরোপিত ও মনোনীত নেতৃত্ব এ অবস্থার বড় সংকট। লড়াই-সংগ্রামসহ নানা পরিস্থিতি-বাস্তবতার মধ্যদিয়ে নেতৃত্ব আসছে না।
পরিবর্তনের হাওয়া লাগুক অন্য দলেও
কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান দু’টি বামদল বাংলাদেশর কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সম্মেলন (২৮-৩১ জানুয়ারি) হয়েছে। সেখানে এ অবস্থার কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেছে। সিপিবি’র সম্মেলনে (২৫-২৮ ফেব্রুয়ারি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে মূল নেতৃত্ব থেকে ২৮ বছর পর বিদায় দিয়ে শাহ আলমকে সভাপতি ও রুহিন হোসেন প্রিন্সকে সাধারণ সম্পাদক করে ৪৩ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। মূল নেতৃত্বে পরিবর্তন হলেও তাদেরও বয়সও ৬০ এর উপরে। এবং বাসদের সম্মেলনে খালেকুজ্জামানকে ৪১ বছর পর মূলনেতৃত্ব থেকে বিদায় দিয়ে বজলুর রশীদ ফিরোজকে সাধারণ সম্পাদক ও রাজেকুজ্জামান রতনকে সহসাধারণ সম্পাদক করে ১২ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। নেতৃত্বের এই পরিবর্তন অনেক আগেই আসা উচিত ছিল। বিলম্ব হলেও নেতৃত্ব পরিবর্তনের এই ধারা রাজনীতিতে কিছুটা হলেও গুনগত পরিবর্তন আনবে।
স্রোতস্বিনী নদীতে কখনো শ্যাওলা জন্মে না। যে নদী স্রোতহীন সেখানেই শ্যাওলা জন্মায়। দল ও রাজনীতিতে যদি ধারাবাহিক নেতৃত্বের পরিবর্তন না আনা হয়, তাদেরকে চ্যালেঞ্জ না দেয়া হয়, সেখানে স্থবিরতা ও বন্ধাত্ব আসবেই।
লেখক: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পিএনএস/আনোয়ার
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব: বাম বলয়ে পরিবর্তনের হাওয়া
06-03-2022 10:30AM