পিএনএস ডেস্ক: ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিকি হ্যালির করা মন্তব্য অক্ষরে অক্ষের মিলে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নিকি মন্তব্য করেছিলেন, কমিউনিস্ট শাসিত চীন ‘ইতিহাসের ছাইয়ের স্তূপে’ ঠাঁই পাবে। সাউথ ক্যারোলিনার উপকূলীয় শহরে তিনি বলেছিলেন, ‘চীনের স্বৈরশাসকরা বিশ্বকে কমিউনিস্ট অত্যাচারে ঢেকে দিতে চায়। একমাত্র আমরাই তাদের থামাতে পারি।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল শত্রু হচ্ছে কমিউনিস্ট চীন।
চীনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিকি হ্যালির পূর্বাভাসকেই সত্য বলে প্রমাণ করতে চলেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি, প্রবীণ চীনা নাগরিকরা তাদের সুবিধা বন্ধের প্রতিবাদে উহান শহরে বিক্ষোভ দেখান। সংবাদ সংস্থা এপি বেইজিং থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বিক্ষোভকে ‘স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সাথে সংঘর্ষের একটি বিরল লক্ষণ’ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
সাংবাদিকদের ওপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নজরদারি উপেক্ষা করে উহানের ঝংশান পার্কের সামনের সেই বিক্ষোভের ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
সেই ভিডিওয় দেখা গেছে শত শত প্রবীণ মানুষ প্রধান সড়কে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। তাদের "দ্য ইন্টারন্যাশনাল" গাইতেও দেখা যায়। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপির শাসন শুরুর পর চীনে বিক্ষোভ বিরলতম ঘটনা। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিক্ষোভটি চীনের ‘শূন্য কোভিড’ নীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ।
উহানে স্থানীয় সরকারের কোষাগার প্রায় শূন্য। নির্মাণ শিল্পের ব্যবসা ধ্বংস হতে বসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সামাজিক কল্যাণের প্রতিশ্রুতি প্রদানে স্থানীয় সরকারগুলির ব্যর্থতার প্রতিবাদে গর্জে উঠছেন চীনের নাগরিকরা। প্রবীণ নাগরিকদের সমস্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্র পেনশন ও স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতিশ্রুতির দিলেও কিছুই করছে না। ক্রমহ্রাসমান জন্মহার এবং ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সমস্যা আরও বড়িয়ে তুলেছে।
চীনের কমিউনিস্ট শাসকরা সাম্প্রতিক মাসগুলিতে বেশ কয়েকটি গণ-প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সঝাঁঝ বাড়ছে। ২০২২ সালের শেষের দিকে কঠোর লকডাউনের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের তরঙ্গ অনুভব করে চীন সরকার। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ করে ‘শূন্য কোভিড’ নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় তারা। এর আগে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিবাদ হয়েছিল। ২০২২ সালের অক্টোবরে ২০ তম পার্টি কংগ্রেস তৃতীয় মেয়াদের জন্য শি জিনপিংকে নির্বাচিত করে তাকে কার্যত আজীবন প্রেসিডেন্ট করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সাংহাইতে ২৭ নভেম্বর বিক্ষোভকারীরা লকডাউনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় ‘শি জিনপিং পদত্যাগ করুন’ বলে আওয়াজ তোলেন।
শুধু সাধারণ চীনা জনগণই নন, চীনের শীর্ষ উদ্যোক্তারাও কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগে এখন ভীত। অথচ এরাই গত কয়েক দশক ধরে নাটকীয় প্রবৃদ্ধির গল্প রচনা করেছিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি উহানে বিক্ষোভ চলাকালীন, হংকং থেকে খবর আসে যে চীনের শীর্ষ বিনিয়োগ ব্যাংক ‘চায়না রেনেসাঁ’ তাদের প্রতিষ্ঠাতা বাও ফ্যানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। চীন রেনেসাঁর শেয়ারও বিপর্যস্ত।
গত দুই বছরে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে ধস নামার পর বাও নিখোঁজ। গত বছর সেপ্টেম্বরে চীন রেনেসাঁর সাবেক প্রেসিডেন্ট কং লিন নিখোঁজ হওয়ার পর এবার বাও নিখোঁজ হলেন। পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী তদন্তের নামে এভারব্রাইট সিকিউরিটিজ, চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক এবং আইসিবিসি-এর মতো প্রতিষ্ঠানের কয়েক ডজন কর্মকর্তা এবং অর্থ নির্বাহীকে আটক করা হয়েছে।
কঠোর লকডাউনের হাত ধরে নির্মাণ শিল্পের ব্যাপক পতনের ফলে অদূর ভবিষ্যতে চীনা অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের কোনও আশা নেই। চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং নিজেই ‘দেশের অর্থনীতির অবস্থা’ বিষয়ক সরকারি মাধ্যমে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এটি স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন যে চীনের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা ‘জটিল’ হয়ে উঠেছে। আর তার জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে ‘বিনিয়োগ আকর্ষণের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা’কে। নিজেদের ব্যর্থতার বিষয়ে উদাসীন শি। গত ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবার চীনে প্রবৃদ্ধির হার মাত্র তিন শতাংশে নেমে এসেছে। প্রেসিডেন্ট শি এই বিপর্যয়ের জন্য শুধুমাত্র সম্পত্তি খাতে মন্দা এবং স্থানীয় সরকারের ঋণের স্তূপকে দায়ী করেছেন। অনুমান করা হচ্ছে, চীনের স্থানীয় সরকারগুলির ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৫৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রতিবেদন অনুসারে, অনেক আমেরিকান ও ইউরোপীয় কোম্পানি চীন থেকে তাদের আয়ের প্রত্যাশা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের বিবেচনায় এখন বিনিয়োগ স্থানান্তরের চিন্তা। ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বেইজিং ‘শূন্য কোভিড’ নীতি থেকে বিশৃঙ্খল প্রস্থান করায় ২০২২ সালের শেষ দুই মাসে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চীনে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় প্রায় ২৯ শতাংশ কম হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে ৩৩ শতাংশ হ্রাস পায়। এটাই ২০১৫ সালের পরে সবচেয়ে বড় পতন।
চীনের জন্য আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ‘জিরো কোভিড’ নীতির কারণে সৃষ্ট সমস্যা ও বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপর সরকারি দমন-পীড়নের কারণে বিনিয়োগকারীরা চীনের বদলে ভারত-সহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছেন।
চীনে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা গত বছরের শেষে ২৬ কোটি ৭০ লাখে পৌঁছেছে। অর্থাৎ চীনের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশই বয়স্ক মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই কাজ করার উপযুক্ত বয়সের লোকের সংখ্যা কমছে। তাই চীনেও বাড়ছে মজুরির হার। ফলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণও কমছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এখন বিনিয়োগের জন্য ভারতের মতো দেশগুলিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করায় চীনের অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির বেলুন চুপসে গেছে। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরাম গুলোর ভাষ্যমতে এশিয়ায় আগামী দশক জুড়ে বিনিয়োগের জন্য বিকল্প শ্রেষ্ঠ স্থান হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ভারতে দেয়া বক্তব্যেও বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ঘোষণা করেছে।
১৭ ফেব্রুয়ারি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে শীর্ষ আমেরিকান সিনেটর চাক শুমার মন্তব্য করেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসীর মুখে প্রচলিত গণতান্ত্রিক বিশ্বকে একসাথে কাজ করতে হবে। শুমার বলেন, ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখে গণতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা যাতে ভেঙে না যায় তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে একটি চীনা নজরদারি বেলুন নিক্ষেপ করার কথা উল্লেখ করে সিনেটর বলেন যে চীনা নজরদারি বেলুনগুলি বিশ্বের ৪০ টিরও বেশি দেশে নজরদারি চালাচ্ছে। গুপ্তচরবৃত্তিই শুধু নয়, এই চর বেলুন চীনের আধিপত্য বিস্তারেরও হাতিয়ার। তার সতর্কবার্তা, "চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে শত শত বিলিয়ন উৎসর্গ করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীনের উদ্ভাবন তাদের নাগরিকদের নিরীক্ষণ ও নিপীড়ন করার ক্ষমতা দিয়েছে। চীনকে প্রতিহত করতেই হবে।"
ভারতে নিযুক্ত সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রিচার্ড ভার্মা ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ককে "একুশ শতকের জন্য সংজ্ঞায়িত অংশীদারিত্ব" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বেইজিংকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ আর সহজ হচ্ছে না চীনের। ফলে চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গল্পে নামছে যবনিকা।
অন্যদিকে, ভারত উৎপাদন খাতে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য একটি পছন্দের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ভারতের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, কোভিড-এর পরে ভারতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ ২৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১-২২ সালে উৎপাদন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে মোট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। কম্পিউটার সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার শিল্পেই ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। শেয়ারের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি ২৭ শতাংশ এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ শতাংশ। এই সূচকগুলি থেকেই স্পষ্ট, চীনের অর্থনীতি ডুবতে বসলেও ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেক বেশি উজ্জ্বল।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পিএনএস/আনোয়ার
‘ইতিহাসের ছাইয়ের স্তূপে’ ঠাঁই হবে কী কমিউনিস্ট চীনের
22-03-2023 01:18PM