আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলে কী ঘটবে?

  27-02-2025 08:43PM

নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়াশিংটনের সম্ভাব্য প্রত্যাহার নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের জি-২০ সম্মেলনে অংশ না নেওয়াটা এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে কী ঘটবে?

• কী করে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে এই দু’টি প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিল। বৈশ্বিক সংহতি ও ভবিষ্যতের যুদ্ধ ঠেকাতে উৎসাহ জোগানোর লক্ষ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়।

১৯৭৬ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর গ্রিস থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনার তীব্র ঋণ খেলাপি হওয়া ও এমনকি যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর আর্থিক সংকটেও সর্বশেষ ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে আইএমএফ।

সংকট এড়াতে পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেশগুলোকে আর্থিক ভারসাম্য মোকাবিলায় জরুরি নগদ অর্থ ও ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে সংস্থাটি। আইএমএফ ঋণের সঙ্গে দেশগুলোতে সংস্কার কার্যকর, অতিরিক্ত ব্যয়ে কাটছাঁট, অধিক স্বচ্ছ বাজেট প্রণয়ন, দুর্নীতি নির্মূল কিংবা কর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য শর্ত জুড়ে দেয়।

আর বিশ্বব্যাংক দেশগুলোতে রেলপথ থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ ও সবুজ বন্ডের মতো উদ্ভাবনী আর্থিক খাতের প্রয়োজনীয় ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি এবং ঝুঁকি বীমা সরবরাহ করে; এমন সকল কাজে সহায়তা করার জন্য স্বল্প হারে ঋণ দেয়। ঋণদাতা এই দুই সংস্থাই সেচ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়েও বিশেষজ্ঞ মতামত সরবরাহ করে।

• আইএমএফের সহায়তা কাদের প্রয়োজন?
উদীয়মান বাজার ব্যবস্থার দেশগুলো আইএমএফের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসেবে আর্জেন্টিনার কথা বলা যায়। এই দেশটি আইএমএফের সহায়তা ছাড়া সরকারি কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে পারে না। এছাড়া সেনেগাল থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্তও বর্তমানে আইএমএফের নগদ অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

আইএমএফের প্রোগ্রাম থাকা দেশগুলোতে বিনিয়োগকারীদেরও বেসরকারি ও দ্বিপাক্ষিক দিক থেকে মূল্যায়ন করা হয়। ইউরোপের বৃহত্তম সম্পদ ব্যবস্থাপক আমুন্ডির উদীয়মান বাজারবিষয়ক প্রধান ইয়ারলান সিজদিকভ বলেন, দীর্ঘ, দীর্ঘ সময় ধরে ঋণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছে আইএমএফ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দক্ষতা এবং কেবল অর্থ নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের আইএমএফ প্রোগ্রামযুক্ত দেশগুলোতে আত্মবিশ্বাস জোগায়।

সৌদি আরবের মতো দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগকারীরাও তাদের ঋণ বিতরণের ভরসা হিসাবে ক্রমবর্ধমান হারে আইএমএফের দিকে নজর রাখে। দেশটির অর্থমন্ত্রী ফয়সাল আলী ইব্রাহিম বলেছেন, আইএমএফসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ঋণের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার, প্রতি রিয়াল আরও বেশি মূল্য নিশ্চিত করে।

• বিশ্বব্যাংক কী করে?
পরিষ্কার জ্বালানি ও অবকাঠামোর জন্য দেশগুলোর প্রয়োজনীয় প্রায় ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি বিনিয়োগের প্রধান শাখা আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স করপোরেশনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থায়ন ও উন্মুক্ত অর্থনৈতিক মডেল মেনে চলতে উৎসাহিত করার জন্য তাদের ব্যবহার করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মুদ্রা ও আর্থিক ইনস্টিটিউশন ফোরামের (ওএমএফআইএফ) চেয়ারম্যান, মার্কিন অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও আইএমএফ বোর্ডের সাবেক সদস্য মার্ক সোবেল বলেন, উভয় প্রতিষ্ঠান তাদের বৃহত্তম অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে মিসর, পাকিস্তান এবং জর্ডানের মতো দেশগুলোতে আর্থিক সহায়তা দেয়; যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘‘যদি বিদেশে (যেখানে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে) অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়, তাহলে সেটি মার্কিন অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে।’’

• উন্নয়নশীল বিশ্ব কি তাদের চায়?
আইএমএফ প্রায়ই জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস বা করের আয় বাড়ানোর মতো বাজেটে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অপ্রিয় সংস্কারের পক্ষে পরামর্শ দেয়। যা নিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে সাধারণ জনগণের মাঝে ক্ষোভ দেখা যায়।

গত গ্রীষ্মে আইএমএফের সুপারিশের পর কেনিয়ায় তীব্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় দেশটির অনেকে আইএমএফের নিন্দা জানায়। কিউবা, উত্তর কোরিয়া এবং তাইওয়ানের মতো অল্প কিছু দেশ ও অঞ্চল রয়েছে, যারা আইএমএফের সদস্য নয়।

• যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন প্রত্যাহার করলে কী ঘটবে?
নিউবার্গার বার্মানের উদীয়মান বাজারের ঋণ বিষয়ক পরিচালক কান নাজলি বলেন, ‘‘এটি একটি বিপর্যয় হবে।’’

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র আইএমএফের বৃহত্তম অংশীদার। আইএমএফে ১৬ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংকেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন প্রায় একই পরিমাণের। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার এই হয়ে উঠেছে এই দুটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক নেতারা প্রতিষ্ঠান দুটির ওপর নির্ভর করেন।

সংস্থা দুটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীদেরও অবাক করে দেবে। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াশিংটনকেও তুলনামূলক কম খরচে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের সুবিধা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি পিছিয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে চীন ও অন্যদের বিশ্বনেতা হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে অন্যান্য দেশগুলো আর্থিক ‍শূন্যতা পূরণ করতে পারে। বিশেষ করে চীন বৈশ্বিক সংস্থাগুলোতে বৃহৎ ভূমিকা রাখার বিষয়ে আগ্রহী। অতীতে আইএমএফের অংশীদার পুনর্গঠন ও উদীয়মান বাজারের দেশগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য চাপ দিয়েছে চীন। সংস্থা দুটিতে চীনের বর্তমান শেয়ার ৫ শতাংশের কিছু বেশি।

সোবেল বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান সংস্থাগুলোর কার্যকারিতায় বিশাল ধাক্কা তৈরি করবে এবং তা কেবল চীনকেই সহায়তা করবে। সূত্র: রয়টার্স।

এসএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন