পিএনএস ডেস্ক: জুলাই বিপ্লব চলাকালে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট শেখ হাসিনার পতনের পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে এ অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। একইসঙ্গে নিবন্ধটির মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততা জোরদার এবং অভিন্ন স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে ভারত সরকারকে বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে কাজ করার আহ্বানও জানান তিনি।
নিবন্ধটিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা লিখেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক একটি জটিল জায়গায় পৌঁছেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে— শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট। তা সত্ত্বেও, আমাদের দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ এবং সহযোগিতামূলক সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং আমি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিবাচক দিকগুলো তৈরি করতে এবং উত্তেজনা ও ভুল বোঝাবুঝি বাস্তবসম্মতভাবে সমাধান করার জন্য যথাযথ গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে ইচ্ছুক।
তিনি লিখেন, আমাদের অবস্থান শুরু থেকেই স্পষ্ট: আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ভারতের সাথে একটি ভালো কার্যকর সম্পর্ক চাই। আমরা প্রত্যাশা করি, ভারতের নেতারা আমাদের ইচ্ছার প্রতিদান দেবেন। ডিসেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রীর ঢাকা সফর ছিল এই সঠিক পথের দিকেই একটি পদক্ষেপ। আমাদের উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতার ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই আছে এবং এর ধারাবাহিকতা উভয় দেশের জনগণের জন্য উপকারী হবে।
তৌহিদ হোসেন লিখেন, ২০ শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে ভারত অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছে, তা বৈশ্বিক প্রভাবের সাথে তার প্রাণবন্ত প্রযুক্তি খাত হোক বা দেশটির অর্থনীতি, যা এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। বাংলাদেশেরও উল্লেখযোগ্য অর্জনের ক্ষেত্র রয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় আমাদের অবদান অন্য যেকোনও দেশের চেয়ে বেশি, তারা সারা বিশ্বের হটস্পটে প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান করে। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের তৈরি করা ক্ষুদ্রঋণ মডেলগুলো বিশ্বব্যাপী শিল্পের সৃষ্টি ও সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়েছে এবং ভারতেও ব্যাপক আকারে অভিযোজিত হয়েছে।
তিনি আরও লিখেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতি আচরণ নিয়ে ভারতে অনেক শোরগোল সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিদ্যমান শূন্যতার সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। এগুলো বিশেষ করে পূর্ববর্তী সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যাদের অধিকাংশই মুসলমান, কিন্তু হিন্দুও রয়েছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এ ধরনের অপরাধকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। সারা দেশের নাগরিকরাও সাহসের সাথে এবং সফলভাবে হিন্দু পরিবার ও মন্দির রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় মিডিয়া এবং সাইবারস্পেস ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত এবং প্রায়শই সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ প্রকাশ এবং পুনরাবৃত্তি করে নেতিবাচক হাইপ তৈরি করে চলেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা লিখেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বাংলাদেশের হিন্দুরা সমান অধিকারের অধিকারী। ভয়েস অব আমেরিকার পরিচালিত একটি স্বাধীন সমীক্ষায় বলা হয়েছিল— আমাদের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিশ্বাস করে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়া এবং তার বাইরেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল হতে চাই। আমরা ভারতীয় সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানাই এবং কোন বিধিনিষেধ ছাড়াই যা ঘটছে তা রিপোর্ট করার জন্য। যেন ভারতীয় জনগণ তাদের নিরপেক্ষ তদন্ত থেকে সত্য জানতে পারে।
সার্ক পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এরপর তিনি লিখেন, অন্তর্বর্তী সরকার সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা করেছে, আঞ্চলিক এই সংস্থাটি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিলুপ্ত হয়ে আছে। এ বিষয়ে ভারতীয় প্রতিক্রিয়া এখনও পর্যন্ত ইতিবাচক নয়। এই প্রচেষ্টা থেকে ভারতের ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা জানি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু হাজার মাইল যাত্রা শুরু হয় একটি মাত্র পদক্ষেপ দিয়ে। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে, আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতিকে সংকেত দেওয়ার জন্য আমাদের নেতারা কি পরবর্তী বৈশ্বিক সমাবেশে একসাথে ছবি তোলার জন্য দাঁড়াতে পারে না?
তৌহিদ হোসেন আরও লিখেন, নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কিছু ইতিবাচক দিক দেখেছি, যেমন (উভয় দেশের) জেলেদের সাম্প্রতিক বিনিময় এবং (বাংলাদেশ-নেপাল-ভারতের মধ্যে) সাম্প্রতিক একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে যা বাংলাদেশকে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনার সুযোগ দেবে। আসুন একটি অংশীদারিত্ব তৈরি করতে এই ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই যা আমাদের জনগণ, অঞ্চল এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সবার জন্যই উপকৃত হয়। এক্ষেত্রে একটি ভালো সূচনা হবে সীমান্তে নিরস্ত্র বেসামরিকদের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা। ইতিবাচক এবং বাস্তববাদী পদক্ষেপ থেকে আমাদের জনগণের অনেক কিছুই অর্জন করার আছে। আমরা যাতে এই সুযোগটি না হারাই।
পিএনএস/আনোয়ার
শেখ হাসিনার পতনের পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট
06-02-2025 03:33PM