নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত বিএনপি, কোণঠাসা গিয়াসউদ্দীন

  09-10-2024 06:49PM

সুলতান সোহান: যতই দিন যাচ্ছে কঠিন সমীকরনের মুখোমুখি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতি। ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে আনেকেই তাকিয়ে আছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে।

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে ইতোমধ্যে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহামুদ। এছাড়াও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরীও রয়েছেন এই তালিকায়। বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাব্য তালিকায় আরো আছেন দলটির সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শিল্পপতি মুহাম্মদ শাহ আলম। এছাড়াও নির্বাচন কাছাকাছি চলে এলে মনোনয়ন প্রত্যাশির সংখ্যা বেড়ে ডজন খানিকে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করছেন এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ফলে দলীয় মনোয়ন পাওয়া কারো জন্যই খুব সহজ হবে না তা সহজেই অনুমেয়।

এদিকে রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরীর নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণার বিষয়টি ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখছেন দলটির তৃণমূল কর্মীরা। তবে অধিকাংশের ধারণা তার এই সিদ্ধান্ত নিজের মনোনয়ন পাওয়ার চেয়ে বরং জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দীনের গতিরোধ করার রাজনৈতিক কৌশল। এছাড়াও এই আসনে গিয়াসউদ্দীনকে ঠেকাতে মূল প্রতিদ্বন্ধী হয়ে মাঠে থাকবেন দলটির হেভিওয়েট প্রার্থীর তালিকায় থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শিল্পপতি মুহাম্মদ শাহ আলম ও অধ্যাপক মামুন মাহামুদ।

২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে জোটভুক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসাইন কাসেমীকে মনোনিত করে বিএনপি। নির্বাচনের পর অভিমানে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও থানা বিএনপির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন শাহ আলম। তবে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে বহাল আছেন। অনেকের ধারণা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই খোলস থেকে বেড়িয়ে মাঠে নামবেন শাহ আলম। তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি চাপে থাকবেন এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন।

নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফতুল্লা থানা বিএনপির বৃহত্তর অংশের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দীনের। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে নেতাকর্মীদের বৈরীতার এই চিত্র ছিলো দৃশ্যমান। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে সখ্যতা ছিলো গিয়াসউদ্দীন পরিবারের। এছাড়াও গিয়াসউদ্দীনের ছেলে সাদরিল আওয়ামী লীগের আইওয়াসের নির্বাচনে নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সিটি মেয়র আইভির আস্থাভাজন বলেও পরিচিতি। গিয়াসউদ্দীন পরিবারের এহেন আওয়ামী প্রীতির জন্য দলে তার গ্রহণযোগ্যতা কমেছে বলেও মনে করেন দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

এদিকে ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চারবারের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু দীর্ঘ সময় দলের বাইরে থাকলেও এবার ঘরে ফিরার চেষ্টা করছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক আলোচিত ও জনপ্রিয় নেতা সেন্টু ২০১৪ সালেও নির্বাচনের আগে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশি হিসেবে প্রচার প্রচারণা চলান। কিন্তু দল সেসময় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় পরে থেমে যান সেন্টু চেয়ারম্যান। ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলেও সেন্টু ও রিয়াদ চৌধুরী উভয়েই ছিলেন গিয়াসের বিরুদ্ধে। তাছাড়া সেন্টু বিএনপিতে ফিরলেও গিয়াস বলয়ে যে যাবেন না সেটার প্রতিফলন কদিন আগেও গিয়াসের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।

এছাড়াও থানা বিএনপির বর্তমান সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটুও গিয়াসের বলয়ের বাহিরে। তাছাড়া টিটুকে বিএনপির রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে সেন্টুর ভুমিকা সবচেয়ে বেশি বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এদিকে থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক জাহিদ হাসান রোজেল ও সাবেক সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম পান্না মোল্লাও শাহ আলম বলয়ে বহাল রয়েছেন। শাহ আলমের পক্ষে আছেন থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বিশ্বাসও।

পক্ষান্তরে ফতুল্লায় একমাত্র গিয়াসের পক্ষে আছেন কোর্ট কেন্দ্রীক রাজনীতি করে আসা থানা বিএনপির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল বারী ভুঁইয়া ও জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি। এই রনিও শিল্পপতি শাহ আলমের হাতে প্রতিষ্ঠিত নেতা। এই মুহুর্তে রনি গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে থাকলেও যে কোনো সময় ভিড়তে পারেন শাহ আলমের দিকে। এছাড়াও আলোচনায় আছেন সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী। ফলে ফতুল্লা থানা বিএনপির রাজনীতি যে গিয়াসের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে তা দিনের আলোর মত স্বচ্ছ। অনেকে মনে করছেন সামনের নির্বাচনে গিয়াসকে ঠেকাতে গিয়াসবিরোধী নেতারা একজোট হয়ে নির্বাচনী মাঠে নামতে পারেন।

অন্যদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির রাজনীতির সিংহভাগ জুড়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় রয়েছেন গিয়াসউদ্দীন। তবে এখানেও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহামুদ একটি বলয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যদিও তার বলয় থেকে ইতিমধ্যে গিয়াস বলয়ে ভিড়েছেন থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল হাই রাজু, থানা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক টিএইচ তোফা ও মহানগর যুবদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামসহ আরও বেশকজন নেতা। এছাড়া থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি জুয়েল রানা এক সময় গিয়াসের সঙ্গে রাজনীতি করলেও তারা এখন মামুন মাহামুদের সঙ্গী হয়েছেন। থানা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব শাহ আলম হীরা, থানা বিএনপি নেতা অকিল উদ্দীন ভুঁইয়া, গাজী মনির হোসেন, সামসুউদ্দীন, জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য রিয়াজুল ইসলাম, বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী লেকু, মহানগর যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আক্তারুজ্জামান আক্তার, থানা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এরশাদ আলীসহ আরো বেশকজন শীর্ষ নেতারা আছেন মামুন মাহামুদের বলয়ে।

জানা গেছে, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ২১ দিন আগে কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়ন পান গিয়াসউদ্দীন। ওই নির্বাচনে প্রথমে দলের মনোনয়ন পান সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শিল্পপতি সফর আলী ভুঁইয়া। কিন্তু সফর আলীর মনোনয়ন বাতিল করে গিয়াসউদ্দীনকে মনোনিত করে বিএনপি। নির্বাচনে শামীম ওসমানকে হারিয়ে গিয়াসউদ্দীন সেসময় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে গিয়াসের পক্ষে নির্বাচনে মূল ভূমিকায় ছিলেন শিল্পপতি মোহাম্মদ আলী। কিন্তু বিজয়ী হয়ে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গেই দূরত্ব বাড়ান গিয়াসউদ্দীন। তবে প্রকাশ্যে রাজনীতি না করলেও আগামীর নির্বাচনে মোহাম্মদ আলী যে শাহ আলমের পক্ষে থাকবেন এটা প্রায় নিশ্চিত।

এদিকে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকাকে সোনারগাঁও উপজেলার সঙ্গে যুক্ত রেখে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন গঠিত হয়। যে কারনে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে গিয়াসউদ্দীন সোনারগাঁয়েও জোড়ালোভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন। তবে সামনের নির্বাচনেও সিদ্ধিরগঞ্জকে আবারো সোনারগাঁয়ের সঙ্গে যুক্ত করে আসন বিন্যাস করা হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। সেক্ষেত্রে গিয়াসের জন্য জটিলতা কিছুটা কেটে গিয়ে চাপ সৃষ্টি করবে সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের উপর। তবে সবমিলিয়ে পরিসংখ্যান বলছে নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনে বিএনপির কাণ্ডারী কে হবেন তা অনিশ্চিত।

এসএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন