মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে সময়োপযোগী আইন সময়ের দাবি

  27-01-2019 05:01PM

পিএনএস (মোহাম্ম জাহাঙ্গীর আলম প্রধান) : আধুনিকতার এ যুগে মানসম্পন্ন শিক্ষা সবার চাওয়া। যে শিক্ষার অভাবে সমাজে কাক্সিক্ষত আলোকিত মানুষ তৈরি হচ্ছে না। গুণগত মানের শিক্ষার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। আধনিকতার এ যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুশিক্ষিত জাতি গঠনে মান উপযোগী শিক্ষা সময়ের দাবি। গদবাধা শিক্ষার পরিবর্তে ভবিষ্যৎ নাগরিক আজকের শিশুরা যেন প্রকৃত অর্থে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞানে-গুণে মানবীয় গুণাবলি অধিকারী হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখে সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। সার্টিফিটেট অর্জনের শিক্ষার বদলে তাদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কর্মমুখী চিন্তা বাদ দিয়ে সত্যিকার অর্থে তাদের কর্মোপযোগী করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

এক গাদা বইয়ের যুগ শেষ নয়। আধুনিকতার এ যুগে ওইসব অচল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বসভার ভালো দিকগুলো খুঁজে খুজে এনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় নকলের মতো কালো চিন্তা থাকবে না। থাকবে না কোচিং বাণিজ্য। হাতে-কলমের শিক্ষাটা যথাস্থানে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বাধা কোথায়? শিশুরা যা দেখে, তা শেখে। শিশু বয়সে যেটা শেখে, সেটা সহজে ভুলে না। বরং তাদের এটা হৃদয়ঙ্গম হয় সহজে। ঢুকে যায় একেবারে মগজে। তবে ঢুকানোর কারিগ কে হতে হবে স্নেহপ্রবণ, বন্ধুবৎসল; সর্বোপরি বাবা-মায়ের মতো। ধমক, ভয়, চোখ রাঙিয়ে নয়, নয় শাস্তি, খেলাচ্ছলে বরং পারলে নেচে- গেয়ে তার মতো করে শিক্ষাটা শিশুর কোমল হৃদয়ে গেঁথে দিতে হবে। সেখানে একবার গেঁথে গেলে ওকে আর পায় কে?

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক গলদ রয়েছে। গলদগুলো চিহ্নিত করে দূর করা জরুরি। আশার কথা, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসেছেন। সমস্যাগুলো শুনেছেন। জরুরি ভিত্তিতে সেগুলো চিহ্নিতপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণে তাকে আন্তরিক মনে হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তিনি নকল ও দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতে ৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন। নকলমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠানে যারপরনাই তিনি তৎপর। ১৪ জানুয়ারি শিক্ষার মান উন্নয়নে নতুন পাঠ্যপুস্তকের কারিকুলাম পরিবর্তন, প্রশ্নফাঁস রোধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, শিক্ষা প্রশাসন কার্যকর ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন নতুন শিক্ষামন্ত্রী। প্রভাতের সূর্য যেমন বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির শুরুটা সে আশা-জাগানিয়া মেসেজ দিচ্ছে বৈকি।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। সার্টিফিকেট ও কর্মমুখী শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান অর্জনটাকে অগ্রধিকার দিতে হবে। জ্ঞানের সীমা-পরিসীমা নেই। আর জ্ঞান অর্জনের বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার কথঅ বলে গেছেন মহানবী। আরব দেশের মহানবী আরো বলেছেন, শিক্ষাগ্রহণের জন্য সুদূর চীন যেতে। যখন যানবাহন ছিল, ছিল না যান্ত্রিকতার কিছুই, তখন মহানবী চীনে জ্ঞান অর্জনের জন্য যাওয়ার কথা বলার মধ্যে শিক্ষার প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে দায়িত্বশীলদের। ভাবতে হবে শিক্ষার মান উন্নয়নে ও জীবনমুখী করাল লক্ষ্যে। শিক্ষাটা এমন হতে হবে যে, চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওরা যেন নব নব উদ্ভাবনীশক্তিতে মনোনিবেশ করতে পারে, সে জন্য তাদের শুকুমারবৃত্তিকে গড়ে তুলতে হবে।

মননশীল শিক্ষার অভাবে সমাজে শিক্ষার প্রভাব ওভাবে পড়ছে না। বরং কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, কথিত কিছু শিক্ষিত লোকজনের কারণে সমাজটা পতিত হওয়ার উপক্রম। ফলে মানুষ বলতে শুরু করেছে যে, শিক্ষিতরাই সমাজের বারোটা বাজাচ্ছে। কথাটা মোটেও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সমাজে অবক্ষয়ের জন্য মূলত তারাই দায়ী। কারণ তারা জেগে না উঠলে সামাজিক অবক্ষয়ে দূর হচ্ছে না। বরং ঢালপালা মেলছে। পরিণত হচ্ছে মহীরূহে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত সমাজে যা কখনো সম্ভব নয়, হতে পারে না। এ জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন পণ্ডিতজনরা।

সঠিকভাবে নজরদারি ও সুষ্ঠু পরিচালনার অবাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বাসা বেঁধেছে। যে কারণে জ্ঞানদানকারী শিক্ষকরাই প্রকৃত শিক্ষার বদলে বাণিজ্যে গা ভাসিয়েছেন। কোচিং বাণিজ্যের পাশাপাশি ভর্তি, ফরমপূরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ আদায় কওে পার পেয়ে যাচ্ছেন। মূলত এ ধরনের শিক্ষকের কারণেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যাচ্ছে না। সরিষায় ভূত বলে একটা কথা আছে। পরীক্ষায় নকলে ভূত একশ্রেণীর শিক্ষক। তাদের অবহেলায় শ্রেণীকক্ষে কঠিক পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। আর শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষের সে ঘাটতি, পূরণে নিরুপায় হয়ে নকলের আশ্রয় নেয়। শিক্ষার্থীদের নকলের আশ্রয় নিতে যেন না হয়, সে কাজটিতে নতুন শিক্ষমিন্ত্রীকে জোর দিতে হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। অর্থাৎ কোচিং, বাসায় টিউশনি নয়, ক্লাসের শিক্ষা ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের শতভাগ বুঝিয়ে দিতে হবে।

শিক্ষা প্রশাসনকে দুর্নীত মুক্ত করে আরো কার্যকর, কোচিং বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য বন্ধসহ যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ণের পাশাপাশি শিক্ষা আইন পাস কতে হবে। চিহ্নিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে এ আইনের বিকল্প নেই। অন্যথায় কাজির গরু যেমন খাতাপত্রে থাকে গোয়ালে থাকে না, শিক্ষার বাস্তবতা তেমন হলে দেশ ও জাতির বারোটা বাজতে বাকি থাকবে না। নকল এতটা বেড়ে গেছে যে, পরীক্ষায় শুধু নয়, সর্বত্র এর জয়জয়কাল। পরীক্ষা না দিয়েই নকল সার্টিফিকেট মিলছে। এইচএসসি পাস না করেও ডক্টর ডিগ্রিধারীর সংখ্যা সমাজে বাড়ছে। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আসীন সচিবরা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করছেন। ইতিপূর্বে এমন চার সচিবের দেখা মিলেছে। এ জাতির গর্ব ও অহঙ্কার নিয়ে ছিনিমিনি করতে তাদেরও বাধে না। এত বড় পদে আসীন হয়ে তারা যদি লোভ সামলাতে না পারেন, শিক্ষকের ফাঁকিবাজির কারণে সামাজিক সলজ্জা থেকে রক্ষা পেতে শিক্ষার্থীরা আত্মজীবননাশী অপরিণামদর্শী নকলের আশ্রয় নেয়। এসব শিক্ষকদের চিহ্নিত করে পেশাচ্যুতের কাজটি যত দ্রুত করা যাবে, ততই শিক্ষার উন্নয়ন ও নকল মুক্ত পরীক্ষাগ্রহণ সহজ হবে।

গ্রামাঞ্চল, শহর ও রাজধানী ঢাকায় মানসম্মত শিক্ষক মিলছে না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষা অর্জনের পর কোথাও স্থান না পেয়ে অবশেষে শিক্ষকতাকে বাধ্য হয়ে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। এখানে এসেও থেমে থাকে না, অন্য চাকরি চেষ্টায় মগ্ন থাকে। যদিও ফল কমই মিলে। অন্য পেশায় স্থান না পাওয়া অধিকাংশেরই ঠাঁই হয় শিক্ষাঙ্গনে। সেটাও পরীক্ষায় নয়, হয় তদবীর ও টাকা-পয়সার বিনিময়ে। অনেকের হয় জামাই হিসেবে। বড় সার্টিফিকেট আছে অথচ চাকরি নেই, তাদের জামাই হিসে বে বেছে নেন মেে কে সুপাত্রস্থ করতে না পারা বাবারা। পড়ে তাদের ঠাঁই হয় বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায়। জীবনের বড় একটা অংশ চাকরির পিছনে ঘুরে যারা জুতাক্ষয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে হতাশ, তাদের দিয়ে মানুষ গড়ার কারিগরির কাজটা কতটা সফলভাবে সম্ভব; তাও ভেবে দেখতে হবে দায়িত্বশীলদের। শিক্ষাটাকে এতটা অনাদর-অবহেলা আর যেন করা না হয়, সে ব্যাপারটা গুরুত্ব দিতে হবে। এ খাতকে এমন যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে যে, সমাজের মেধাবীরা এই খাতে চাকরি নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, দেবে অগ্রাধিকার। যতদিন এটা না হবে, ততদিন শিক্ষার কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও নকল মুক্ত পরীক্ষা অধরাই থেকে যাবে বলে পণ্ডিতজনরা মনে করেন।

প্রতিবেদক : বিশেষ প্রতিনিধি- পিএনএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন