পিএনএস, বান্দরবান : লেকের স্বচ্ছ জলে মুখ লুকিয়েছে নীল আকাশ। চার পাড়ের সবুজ বনানী মেলেছে সবুজ ডানা। সবুজ আর নীলের মাঝে লেকের বুক চিরে দাড়িয়ে আছে ঝুলন্ত সেতুটি। অসাধারন সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। পাখির কলরবে মুখরিত চারিপাশ। এ যেন অরণ্যের মাঝে ফিরে আসা নতুন করে। প্রিয় পাঠক বলছি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন লেকের কথা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টিত নাইক্ষ্যংছড়ির প্রাণ কেন্দ্রে জেলা পরিষদ ডাক বাংলো ঘেঁষে প্রায় আধা কিলো মিটার দীর্ঘ কার্পোটিং সড়ক যুক্ত প্রাকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত উপবন লেকটি অবস্থিত।
একে আরো সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ পাতার গাছ গুলো। রয়েছে পাহাড়কন্যা নাইক্ষ্যংছড়ির মনোরম ছায়ানিবিড় সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ। যা ভ্রমনার্থীদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাছ থেকে উপভোগ করতে পর্যটকরা ঈদুল আযহা, দূর্গা পূজা ও প্রবারণা পূর্নিমার র্দীঘ ছুটিতে এখন ভিড় জমাচ্ছেন এ লেকে। শৌখিন মৎস্য শিকারিরা উপজেলা পরিষদ থেকে নির্দিষ্ট ফি হারে টিকেট সংগ্রহ করে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ব্যাস্থ সময় কাঠাচ্ছে।
এ উপজেলাতে উপবন লেক ছাড়াও বিনোধনের জন্য বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইনষ্টিটিউট, বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা কুমির প্রজনন কেন্দ্র, উপজেলার হর্টিকালচার সেন্টার, দেশের বৃহৎ রাবার বাগান, আশারতলী গ্রামের চা-বাগান, সদর ইউনিয়নের জারুলিয়াছড়ির সোসং ও কোয়াসং ঝর্ণা অন্যমত। চট্টগ্রাম থেকে ভ্রমনে আসা নব দম্পতি প্রকৌশলি হেলাল উদ্দিন সাদেক ও আয়েশা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন লেকের চারপাশে বাঙ্গালী ও পাহাড়ি অধিবাসীদের বসতি দেখে আমাদের খুব ভাল লেগেছে। সারি সারি কাঠের বাড়ি আর তাদের ভাষা-সংস্কৃতি আদি এ জনগোষ্ঠির জীবনচিত্রের ভিন্নতা তুলে ধরেছে আমাদের কাছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির দর্শনীয় স্থানগুলো ঈদুল আযহার পর থেকে মূখরিত হয়ে উঠেছে। পর্যটকরা আসছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন লেকের দৃশ্য অবলোকনের পর অনেকে রেষ্ট হাউজে রাত যাপনও করছে নিজেরদের সুবিধামত। ঘুমধুমের কুমির প্রজনন কেন্দ্র ও বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনষ্টিটিউটেও ভিড় জমছে পর্যটকদের। নোয়াখালীর সরকার দলীয় সাংসদের ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ী কন্য নাইক্ষ্যংছড়ির উপবন লেকে মাছ ধরার জন্য বড়শি নিয়ে খুব শখের বসে এসেছি। আসলেই নাইক্ষ্যংছড়ির লেকটি খুবই সুন্দর। ঝুলন্ত ব্রীজ,এটির পাশেই একটি ছোট্ট উপজাতীয় পল্লী। পর্যটকদের আর্কষনের অন্যতম উপকরন দীর্ঘ লেক। ছোট ছোট বিশ্রাম ঘর, আর উচুঁ-নিচু পিচঢালা পথ। বিশেষ করে রাতের নাইক্ষ্যংছড়ি দেখতে খুবই দারুন।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফাইল আহমদ বলেন, দর্শণীয় স্থান গুলোর আধুনিকায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে উপজেলা পরিষদের পক্ষ দেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির বিশেষ অর্থায়নে উপবন পর্যটন লেকের উন্নয়ন অতি শীঘ্রই শুরু হবে। এরই অংশ হিসাবে জেলা প্রশাসক মহোদয় লেক পরিদর্শন করেছেন। তাছাড়া সোনাইছড়ি-ঘুমধুম সড়কটি নির্মাণ হলেই পর্যটকের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কারণ এ সড়কটি হলেই ঘুমধুমের কুমির প্রজনন কেন্দ্রে সহজেই পর্যটকরা যাতায়ত করতে পারবে। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর খুবই আন্তরিক বলেও জানান তিনি।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনষ্টিউট :
১৯৮৮ সালে প্রাণিসম্পদ নিয়ে গবেষণার জন্য নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের বিছামারা এলাকায় ১৬২ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়েছিল প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনষ্টিটিউট। বর্তমানে এ ইনষ্টিটিউটে প্রাণী নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত আছেন প্রতিষ্ঠানের ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারি। এখানে ছয়টি গয়াল, পাঁচটি হরিণ, ৪৭টি ভেড়া, ১৪৮টি ছাগল, ৪৫টি বন্য ও ১৯০টি দেশি মোরগ-মুরগি আছে। এসব পাহাড়ী পশু-প্রাণীকে সরাসরি দেখার জন্য পর্যটকরা নাইক্ষ্যংছড়িতে আসছেন।
কুমির প্রজনন কেন্দ্র :
উপজেলার দুর্গম ঘুমধুম ইউনিয়নের পাহাড়ে ২৫ একর ভূমিতে ২০১০ সালের শেষের দিকে মালয়েশিয়া থেকে অর্ধ শতাধিক লোনা পানির কুমির দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা কুমির প্রজননকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। কুমিরের দৌড়ঝাঁপ দেখতে সেখানে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পর্যটকরা। এই দুর্গম পাহাড়ের ওপর পানির কুমিরের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনটা জুড়িয়ে যায় পর্যটকদের। এই খামারটা আসলেই অত্যন্ত মন-মুগ্ধকর।
সোসং ও কোয়াসং ঝর্ণা :
উপজেলার সদর ইউনিয়নের জারুলিয়াছড়িতে অবস্থিত সোসং ও কোয়াসং ঝর্ণা। ঝর্না দুটির মধ্যে একটির উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট ও অপরটি ২০ ফুট। এসব ঝর্ণা দেখলে সৌন্দর্যপিপাসুরা মুগ্ধ হবেন এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। মনোমুগ্ধকর এ দুটি ঝর্ণার সংবাদ পেয়ে অনেকে ছুটে যাচ্ছেন পাহাড় ঘেরা নাইক্ষ্যংছড়ির জারুলিয়াছড়িতে। এ দুটি ঝর্ণা অনেকের কাছেই অপরিচিত। উচু খাড়া পাহাড় হতে ঝর্ণার পানি শো শো শব্দ করে নিচের দিকে পতিত হচ্ছে। অসংখ্য প্রজাতির গাছপালা আর জঙ্গলে ঝর্নার চারপাশ আচ্ছাদিত হয়ে আছে। সেগুলো যেন সবুজের সমারোহ। সেই সাথে পাখির কিচির-মিচির বনের নিস্তব্ধতাকে জাগিয়ে রাখে সারাক্ষণ।
দেশের বৃহৎ রাবার বাগান :
বাণিজ্যিক রাবার চাষে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়ন দ্বিতীয় মালয়েশিয়া হিসাবেই পরিচিত সকলের কাছে। ১৯৮৭ সাল থেকে এখানে দেশের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে তোলা রাবার বাগান ব্যবসায়িকভাবে লাভের মুখ দেখছে। বাইশারী এলাকা রাবার শিল্প সম্ভাবনাময় হওয়ায় স্থানীয়রা এখানকার উৎপাদিত রাবার ল্যাটেক্স’কে তরল ‘সাদা সোনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ উপজেলায় উৎপাদিত রাবার দেশের রাবার শিল্পের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। বাইশারীতে রাবার চাষ করে ব্যবসায়ীকভাবে সফল হয়েছে চিত্রনায়ক সোহেল রানা ও রুবেল। অন্যদিকে দেশের এ বৃহৎ রাবার বাগানে বিভিন্ন ছুটিতে আগমন ঘটে প্রচুর পর্যটকের।
পিএনএস/মো: সাইফুল্লাহ/মানসুর
পর্যটকদের স্বর্গভূমি নাইক্ষ্যংছড়ি
14-10-2014 01:40PM