বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য: শুধু ঋণ নয়, নতুন বিনিয়োগে জোর

  07-07-2024 11:04PM

পিএনএস ডেস্ক: বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত দেড় দশকে বেড়েছে ৪২৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ১৫ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ছিল মাত্র ৩৫১ দশমিক ৪৫ কোটি ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১৮৫০ দশমিক ৪০ কোটি ডলারে। তবে আমদানির তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক কম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণে থাকছে বিশেষ গুরুত্ব।

চীন শুধু বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদারই নয়, তারা দেশের বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে এ সম্পর্কে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। দুই দেশের সরকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিতে আগ্রহী। উন্নয়ন সহযোগী এ দেশটির কাছ থেকে আরও ঋণ প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে চীনকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা ঋণের পাশাপাশি বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করেন।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ১৮৫০ দশমিক ৪০ কোটি ডলারের। চীন থেকে ১৭৮২ দশমিক ৬৬ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে, দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৬৭ দশমিক ৭৩ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭১৫ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ৩৪১ দশমিক ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। আর বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি ছিল প্রায় ১০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য
২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (মে ২০২৪ পর্যন্ত) চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে বেশি। এই সময়ে একক পণ্য হিসেবে চীনে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যার পরিমাণ ২৯ কোটি ডলার।

চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে তুলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২৫ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি হয়েছে নিউক্লিয়ার রেক্টর ও বয়লার- যার মূল্য ছিল ২১৫ কোটি ডলার। ইলেক্ট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র আমদানি হয়েছে ১৭২ কোটি ডলারের।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর
সোমবার (৮ জুলাই) চীনে দ্বিপক্ষীয় সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর চীনে তার প্রথম সফরটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। চীনকে বিনিয়োগে আকর্ষণ করা এ সফরে আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে। মূল উদ্দেশ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং নতুন বিনিয়োগ বাড়ানো।

দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে এ সফর ঘিরে। তাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।

সফরের বিশেষ দিকটি হবে বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি ইউয়ানের বেশি ঋণ। এর মধ্যে বাণিজ্য সহায়তার আওতায় ৫০০ কোটি ডলার ও বাজেট সহায়তার আওতায় ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বাংলাদেশকে দেশটি ঋণ দিতে পারে।

বাংলাদেশ কি শুধু ঋণের প্রতি নজর দেবে নাকি বিনিয়োগেও নজর থাকবে সেটি এখন প্রশ্ন। আবার যদি বিনিয়োগ হয় তাহলে কোন ধরনের শিল্পে? অর্থনীতিবিদ ও বাবসায়ীরা মনে করেন, উৎপাদনমুখী ও পশ্চাদমুখী শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর এবং বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার ও পরিশোধের শর্ত এবং মেয়াদ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, যাতে ঋণের ফাঁদে আটকা না পড়ি।

বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্র
চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ভোগ করে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না রপ্তানিকারকরা। শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগাতে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীন বাংলাদেশের কাছে কী চায়?
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় চীনের ভূমিকা অনেক। চীন বৈশ্বিক কাঁচামাল সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। রপ্তানি ও দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি করি। সুতরাং আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না বরং বাড়বে। কারণ আমাদের ব্যবসার ধরন ও আকার দিন দিন বড় হচ্ছে।’

‘আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে চায়নিজ ব্যবসায়ীদের এখানে নিয়ে আসা যায়, বিশেষ করে আমরা যে ধরনের পণ্য আমদানি করি সেই খাতের ব্যবসায়ীদের। আমরা যদি চাহিদার ৫ শতাংশ কাঁচামাল নিজস্বভাবে উৎপাদন করতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। এতে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে, আমদানিনির্ভরতা কমবে।’ মন্তব্য করেন কাসেম।

‘এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে চীনা বিনিয়োগ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ আমাদের অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেখানে চীনের বিনিয়োগ ও কৌশলগত সহায়তা প্রয়োজন। আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীন এখানে শীর্ষে।’

এ ব্যবসায়ী নেতা দাবি করেন, আমাদের রপ্তানি তৈরি পোশাকখাতনির্ভর। সুতরাং এখানে ভালো করেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। চায়নার বিনিয়োগ পণ্য বহুমুখীকরণ ও উচ্চমূল্যের পোশাক পণ্য তৈরিতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘আমাদের ম্যানমেড ফাইবারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। চীন বৈশ্বিক বাজারে এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তাদের সামর্থ্য, সক্ষমতা ও প্রযুক্তি আছে।’

রাকিব বলেন, ‘আমরা যদি চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে পারি যে তারা এখানে এ শিল্পে বিনিয়োগ করবে এবং আমাদের প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জনে সহয়তা করবে, তাহলে বাংলাদেশ এ খাতে অনেক ভালো করতে সক্ষম হবে।’

‘বাংলাদেশ যদি ম্যানমেড ফাইবারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানিতে চায়না প্লাস হতে চায়, তাহলে আমাদের তাদের কৌশলগত অংশীদার হতে হবে। যে সব দেশ ভালো করেছে তারা এ পদ্ধতির মাধ্যমে করেছে’ বলেন রাকিব।

প্রযুক্তির প্রভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের কাজের ধরন। নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থায়। তাই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রকল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মত দেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) নতুন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এখানে চীনের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে আমাদের এ নতুন প্রযুক্তি উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে।

বিনিয়োগ আকর্ষণে করণীয়
টেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন,
‘চীন আমদানি-রপ্তানির দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করি তার তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। তৈরি পোশাকসহ অন্য শিল্পের পশ্চাদমুখী খাতে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন। বিনিয়োগ এলে আমরা সহজে কাঁচামাল পাবো এবং স্বল্প সময়ে পণ্য রপ্তানি করতে পারবো।’

চায়না থেকে যে সব বিনিয়োগ ও ব্যবসা সরে আসছে সেগুলো আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাদের বিশেষ অঞ্চলে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তুহিন।

তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য আমাদের নীতি ও আইনকে ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। কোথাও কোথাও আইনের সংস্কার প্রয়োজন। শুধু খাতা-কলমে নয়, বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ থাকতে হবে।’

বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) জোরদার করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

ঋণ না বিনিয়োগ?
‘আমরা চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের জন্য তহবিল পাচ্ছি। এগুলো আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক সহায়তা করেছে। কিন্তু উন্নত অবকাঠামোর সুবিধা কাজে লাগাতে শুধু ঋণ নয়, আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে এবং যেখানে বিনিয়োগ বাড়ালে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে সেটার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।’ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যা পিড) চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক একথা বলেন।

তিনে বলেন, ‘চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে উৎপাদনমুখী শিল্পে তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। জোর দিতে হবে পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর। চীনের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে পশ্চাদমুখী শিল্প গড়ে তুলতে হবে।’

অর্থনীতিবিদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারাও ঋণের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন।

আবুল কাসেম খান বলেন, ‘চলমান ও নতুন বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বড় অংকের তহবিল প্রত্যাশা করা হচ্ছে এ সফর থেকে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যাতে আমরা চায়নার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি এবং ঋণের ফাঁদে না পড়ি। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার পরিশোধের সময় এবং সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে। সুদ যাতে কম হয় সেজন্য জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর চীন থেকে বাংলাদেশ ২৬ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মধ্যে থেকে প্রায় ১৩ কোটি ডলার এসেছে জ্বালানি খাতে এবং ৩ দশমিক ৩২ কোটি টেক্সটাইলে। এসময় বাংলাদেশ মোট ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। চীনের অবস্থান ছিল তৃতীয়।

২০২১ সালে কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও ৮৮ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার ছাড় করে চীন। ২০২২ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ১১২ দশমিক ৬৯ কোটি ডলার, ছাড় ৯৮ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ২৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের বিপরীতে ছাড় ১১৩ দশমিক ২৭ কোটি ডলার।

বাংলাদেশকে এ যাবত মোট ১০ দশমিক ২৯ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। ছাড় হয়েছে ৬ দশমিক ৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। ছাড় হওয়ার মধ্যে ১০ কোটি ডলার শুধু অনুদান।

পিএনএস/রাশেদুল আলম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন