পিএনএস ডেস্ক: ইসলামী ব্যাংকসহ আট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম তার নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বের করে নিয়েছেন দুই লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া আরো ডজনখানেক ব্যাংক থেকে তার ঋণ নেয়ার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এসব ব্যাংকে তদন্ত চলছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে এস আলমের অর্থ বের করে নেয়ার পরিমাণ পৌনে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব অর্থের বেশির ভাগই পাচার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পাচারকৃত সম্পদের খোঁজে দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলো কাজ শুরু দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১২টি দেশে পাচারকৃত সম্পদের গন্তব্য সম্পর্কে খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কাজ শুরু করা হয়েছে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থার (সিআইডি) সমন্বয়ে যৌথ কমিশন গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাথমিক তদন্তে এ পর্যন্ত যেসব ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেয়ার প্রমাণ মিলেছে তার মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা (অফশোর ব্যাংকিংসহ), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা (সাবেক রিলায়ান্স) থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে এস আলমের আরো বেনামী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ নেয়ার বিষয়ে খোঁজ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত অবস্থায় ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে এস আলম মুক্ত করা হলেও ঠিক কী পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে তা এখন সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়নি। এমনি পরিস্থিতিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ফরেনসিক অডিট শুরু করছে বিদেশী অডিট ফার্ম।
জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকিং খাত লুটেরাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। দেশের আর্থিক খাতের অভিশাপ বলে চিহ্নিত এস আলমের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আটটি ব্যাংক দখলে নিয়ে যায়। এসব ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের অর্থ পানির মতো বের করে নিতে থাকে। প্রথমে ২০১৭ সালের মে মাসে উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয়। আর এ ব্যাংক দখলের জন্য আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর সিতাশু কুমার সুর চৌধুরীর সহযোগিতায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয় একটি বোর্ডের সভার মাধ্যমে। বিধিবহির্ভূত এসব ঋণ বের করে নিয়ে ওই ঋণের অর্থ দিয়েই ব্যাংকের শেয়ার কিনতে থাকে। এক পর্যায়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এমডিকে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তুলে নিয়ে ব্যাংকটি পুরোপুরি দখলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে পানির মতো টাকা বের করতে থাকে। ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দীন, মিফতা উদ্দীন, কোম্পানি সচিব জেকিইএম হাবিবুল্লাহসহ প্রায় ডজন খানেক ব্যক্তি। আর পদপদবি ধরে রাখতে সহযোগিতা করেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি মাহবুব আলমসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মাহবুব আলমকে এমডি দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর পুরস্কার হিসেবে এস আলমের সহযোগী আরেক ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের উপদেষ্টা করা হয়। পরে দখল করা আরেক ব্যাংক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়। পরবর্তীতে নতুন এমডিকেও এস আলমের অর্থ বের করে নিতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক হিসেবে ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম বের করে নিয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এর সাথে রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ের ১৮ হাজার কোটি টাকা। আরো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা এস আলমের দখল করা অন্য ব্যাংকে মূলধনের জোগান দিতে বাধ্য করা হয় ইসলামী ব্যাংককে। ওই সব ব্যাংক থেকেও এ অর্থ বের করে নেয় এস আলম।
ইসলামী ব্যাংকের মতো সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দখলে নেয় বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম। এমডি ও চেয়ারম্যানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে একটি হোটেলে আটকে তাদের কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেয়া হয়। এরপর রাতারাতি ব্যাংকটির মালিক হয়ে যায় মাফিয়া এস আলম। দখল করার পর ব্যাংকটি থেকে যে পরিমাণ আমানত আসত বেশির ভাগই নামে-বেনামে বের করে নিত এস আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম বের করে নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই পাচার করে দিয়েছে। শুধু অর্থই বের করে নেয়নি, ব্যাংকটিতে প্রায় দুই হাজার নতুন লোকবল নিয়োগ দিয়ে অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলম মুক্ত হলেও তার লুটপাটের ক্ষত এখনো কাটাতে পারেনি ব্যাংকটি। সাধারণ গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না কর্মকর্তারা। ব্যাংকটির নতুন পর্ষদ ও চৌকস কর্মকর্তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন ব্যাংকটিকে ধরে রাখার।
নতুন প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংকও পুরোপুরি মালিকানায় নেয় এস আলম। এ ব্যাংক থেকে বলা চলে পুরো আমানতের অর্থই বের করে নেয় এস আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক হিসাবে এ পর্যন্ত ব্যাংকটি থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। যেখানে আমানত ২৩ হাজার কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের পরে সবচেয়ে বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে। ব্যাংকটি থেকে বের করে নেয়া হয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। তবে এসব ঋণের বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
নতুন প্রজন্মের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকও দখলে নেয় এস আলম। এ ব্যাংক থেকে আমানতের প্রায় পুরো অর্থই অর্থাৎ ১২ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে ব্যাংক ডাকাত এস আলম।
এক্সিম ব্যাংক থেকেও বের করে নিয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে আরেক ব্যাংক ডাকাত এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সমপরিমাণ অর্থ এস আলমের দখলে থাকা ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জনতা থেকে বের করে নিয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। তেমনিভাবে অগ্রণী, রূপালী, সোনালী, ন্যাশনালসহ আরো প্রায় ডজনখানেক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়েছে এস আলম। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি তদন্ত শুরু করেছে।
এ দিকে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মো: সাইফুল আলমের পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ছয়টি ব্যাংকের হিসাবে এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছিল বলে জানতে পেরেছে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্রগুলোর মতে, বর্তমানে এসব হিসাবের স্থিতি ২৬ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংক হলো- ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক; যার মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকই এর আগে ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণে।
তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুরকে নিয়োগের পর থেকেই এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। গত বছরের ১৪ আগস্ট এনবিআরের অধীন ইনকাম ট্যাক্স জোন-১৫ থেকে ৯১টি ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এস আলম, তার পরিবার এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সত্তাগুলোর অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য দিতে বলা হয়। এর এক মাস পরে তারা এসব হিসাবের মধ্যে বিপুল পরিমাণ লেনদেনের ঘটনা খুঁজে পেয়েছে। নাম না প্রকাশের শর্তে ট্যাক্স জোন-১৫ এর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ঋণ ও বিক্রির অর্থসহ এসব ব্যাংকে এ পর্যন্ত তারা এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা জমার সন্ধান পেয়েছেন। তবে এর মধ্যে কত টাকা ঋণের এখনো তা নির্ধারণের কাজ চলছে। তিনি আরো বলেন, ‘এস আলমের পরিবারের সদস্য ও ব্যবসায়িক সত্তাগুলোর এসব হিসাবের বর্তমান স্থিতি ২৬ হাজার কোটি টাকা বলে আমরা জানতে পেরেছি।’ এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এক লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ, প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে এস আলম ও তার সহযোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।
পিএনএস/আনোয়ার
৮ প্রতিষ্ঠান থেকে এস আলমে ২ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা
09-01-2025 10:35AM