পিএনএস ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ অভিবাসন কর্মকর্তা টম হোম্যান। আগামী জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলে তাঁর প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে হোম্যান দেশটির সীমান্ত দেখভাল করবেন।
সদ্যসমাপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত ট্রাম্প গত রোববার ঘোষণা দেন, হোম্যান হবেন তাঁর দ্বিতীয় দফার প্রশাসনের ‘সীমান্ত জার’।
আইনপ্রয়োগ ও সীমান্তে কয়েক দশক ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে হোম্যানের। তিনি এখন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন কমানোর পরিকল্পনা করছেন, সে বিষয়েই সবার নজর থাকবে।
ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে অভিবাসনকে প্রধান নীতিগত ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেন। এখন এ-সংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবেন হোম্যান।
তাহলে হোম্যান ঠিক কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজটি করবেন?
হোম্যান একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইস) সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক।
মার্কিন সীমান্তের অভিবাসন ইস্যুকে ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় জাতীয় নিরাপত্তা দুর্বলতা হিসেবে অভিহিত করেছেন হোম্যান। আর এ সমস্যা অবশ্যই ঠিক করতে হবে বলে তিনি ইতিমধ্যে মত দিয়েছেন।
গত গ্রীষ্মে রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলন হয়। সম্মেলনে হোম্যান যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ অভিবাসীদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা এখনই ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করুন।’
তবে ‘সীমান্ত জার’ হিসেবে হোম্যানের ভূমিকা কী হবে, কী রূপ নেবে তাঁর কর্মসূচি, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, অভিবাসন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সমন্বয়ের বিষয়টি জড়িত।
তবে হোম্যান কীভাবে সীমান্তের অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি সামলাবেন, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা তিনি ইতিমধ্যে দিয়েছেন।
বাইডেনের নীতি উল্টে দেওয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে গত মাসে (অক্টোবর) সিবিএস নিউজের ‘সিক্সটি মিনিটস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন হোম্যান।
সাক্ষাৎকারে হোম্যান ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি প্রথমে জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাজ করবেন। পরে কাগজপত্র ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অপরাধী নন—এমন অভিবাসীদের নিশানা করবেন।
এই ধরনের পদ্ধতির অর্থ বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে উল্টে দেওয়া। কারণ, বাইডেন প্রশাসন আইসকে গুরুতর অপরাধী, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও সম্প্রতি সীমান্ত অতিক্রমকারীদের বিতাড়নের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের নীতি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এবং অপরাধ করেনি—এমন নথিপত্রহীন অভিবাসীদের সুরক্ষায় সহায়তা করছে।
নিশানাভিত্তিক গ্রেপ্তার
হোম্যান বলেছেন, তিনি অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেপ্তার ও বিতাড়ন অভিযান চালানোর সময় একটি নিশানাভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করবেন।
গত অক্টোবরে সিবিএস নিউজের একই সাক্ষাৎকারে হোম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অবৈধ অভিবাসী বিতাড়নের কাজটি ঠিক কীভাবে করা হবে।
জবাবে হোম্যান বলেছিলেন, শহর-উপশহরজুড়ে গণহারে অভিযান চালানো হবে না। এমনকি আটক শিবিরও বানানো হবে না।
হোম্যান বলেন, ‘নিশানা করে অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা কাকে গ্রেপ্তার করব, তা আমরা জানব। সে ক্ষেত্রে আমরা সম্ভবত অনেকগুলো...অনুসন্ধান-তদন্ত প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের খুঁজে পাব।’
পরিবারসহ বিতাড়ন
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের বিতর্কিত ‘শূন্য সহনশীল’ (জিরো টলারেন্স) নীতিতে ভূমিকা রেখেছিলেন হোম্যান। এই নীতির আওতায় হাজার হাজার অভিবাসী শিশুকে তাদের পিতামাতা থেকে আলাদা করা হয়েছিল।
নীতিটি ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। বিশেষ করে যখন অভিবাসী শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল, আর পুনর্মিলনের কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তাদের পিতামাতার বিচার করা হচ্ছিল।
হোম্যান অবশ্য বলেছেন, তিনি ওই নীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যা শিশুদের সঙ্গে তাদের পিতামাতার বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল।
তবে হোম্যান তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনের তিন কর্মকর্তার একজন ছিলেন, যিনি এতে স্বাক্ষর করেছিলেন। হোম্যানের দাবি, মানুষের ‘জীবন বাঁচানোর’ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তিনি এতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
হোম্যান ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি সেই নীতিটি এবার চালু করবেন না।
হোম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পরিবার আলাদা না করে বিতাড়ন করা যেতে পারে কি না। জবাবে তিনি বলেন, অবৈধ অভিবাসী পরিবারের সব সদস্যকে একত্রে (পরিবারসহ) বিতাড়ন করা যেতে পারে।
হোম্যান কীভাবে সীমান্তের অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি সামলাবেন, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা তিনি ইতিমধ্যে দিয়েছেন
হোম্যান কীভাবে সীমান্তের অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি সামলাবেন, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা তিনি ইতিমধ্যে দিয়েছেনছবি: রয়টার্স
কর্মস্থলে গণগ্রেপ্তার
হোম্যান কর্মক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসীদের গণগ্রেপ্তারের নীতি পুনরুজ্জীবিত করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই বিষয়টিকে তিনি কর্মক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আইনপ্রয়োগের অভিযান হিসেবে উল্লেখ করেন। বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে এই নীতি বন্ধ করে দিয়েছিল।
গত সোমবার ফক্স নিউজের ‘ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ অনুষ্ঠানে হোম্যান বলেন, ‘আপনার (অভিবাসী) আশ্রয় দাবি করার অধিকার আছে। এ জন্য বিচারকের সামনে হাজির হওয়ার অধিকার আপনার আছে। আমরা তা করব। কিন্তু সেই যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে যদি বিচারক বলেন, আপনাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে, তাহলে আমাদের তাঁদের (অবৈধ অভিবাসী) ফেরত পাঠাতে হবে।’
পুলিশ কর্মকর্তা, সীমান্ত টহল এজেন্ট
৬২ বছর বয়সী হোম্যান তাঁর পেশাজীবন শুরু করেছিলেন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। পরে তিনি সীমান্ত টহল এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রায়ই তাঁর কর্মজীবনের এই দিকটির (সীমান্ত টহল এজেন্ট) কথা উল্লেখ করেন।
হোম্যান গত সোমবার ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি একজন সীমান্ত টহল এজেন্ট ছিলাম। আমি এই কাজের জন্য নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরেছিলাম। আমি গর্বিত যে আমি এই ইউনিফর্ম পরেছি...আমিই প্রথম আইস পরিচালক, যিনি পেশাগত র্যা ঙ্কের মধ্য দিয়ে এই পর্যায়ে এসেছি।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৩ সালে হোম্যানকে আইস-এর বিতাড়ন শাখার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। সেটি এমন একটি সময় ছিল, যখন সংস্থাটি রেকর্ডসংখ্যক অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়ন করেছিল।
হোম্যান তাঁর কাজের জন্য প্রেসিডেনশিয়াল র্যাছঙ্ক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিসের কোনো সদস্যর জন্য সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।
ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি আইসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে হোম্যানকে নিযুক্ত করেছিলেন। এই দায়িত্বে হোম্যান ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন।
পরে হোম্যানকে সংস্থার স্থায়ী পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এই মনোনয়ন অনুমোদনের বিষয়ে সিনেট কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
হোম্যান বর্তমানে রক্ষণশীল মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজের প্রদায়ক (কন্ট্রিবিউটর) হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ২০২২ সালে রক্ষণশীল হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেন। এই ফাউন্ডেশনের ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ নামের একটি অতি-রক্ষণশীল রাজনৈতিক নীতি প্রস্তাবের একজন প্রদায়ক (কন্ট্রিবিউটর) তিনি।
উল্লিখিত নীতি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের জন্য তহবিল বাড়ানোর কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া আছে আরও জোরালো সীমান্ত পুলিশিং তৎপরতা ও অভিবাসীদের ওপর ফি বাড়ানোর প্রস্তাব।
নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প অবশ্য নিজেকে এই এজেন্ডা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
পিএনএস/আনোয়ার
ট্রাম্পের নতুন ‘সীমান্ত জার’ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর হবেন
14-11-2024 11:28AM