জনকেন্দ্রিক পুলিশিংয়ে কয়েক গুচ্ছ পরামর্শ

  08-02-2025 09:56PM

পিএনএস ডেস্ক: জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের জনবিরোধী ভূমিকা পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্কে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।

কমিশন মনে করছে, এর পেছনে পুলিশের নেতৃত্বস্থানীয় অংশের মধ্যে ক্ষমতামুখী হওয়ার প্রবণতা এবং জনবিমুখতার বড় ভূমিকা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে জনকেন্দ্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সেই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে সরকার।

তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের জন্য এখন প্রয়োজন তার আওতাভুক্ত এলাকার কমিউনিটির সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ ব্যবস্থায় পুলিশ জনগণের বিপক্ষে নয়, বরং জনতার কাতারে এসে মানবিকতার সঙ্গে তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং জনগণের কাছেই দায়বদ্ধ থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে যদি জুলাই-আগস্টের মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে কমিউনিটি থেকেই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। অর্থাৎ জনকেন্দ্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে, যা পুলিশের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করবে এবং পুলিশের কাজে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করবে।

জনকেন্দ্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সিস্টেম কেন প্রয়োজন তার উদাহরণ দিতে গিয়ে কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কর্মক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পুলিশের প্রাত্যহিক সুনিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে পরিচালিত কার্যক্রমই জনকেন্দ্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা। এটি একটি প্রক্রিয়া, যা জনসম্পৃক্ততা, জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস এবং সমন্বয় ও সহযোগিতার ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। তবে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে নাগরিক ও পুলিশের সম্পর্ক অবিশ্বাস ও ভয়ের দ্বারা প্রভাবিত। এর মূলে রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগের উত্তরাধিকার, যখন পুলিশ শাসকের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আজও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সীমিত জনসম্পৃক্ততার মতো সমস্যাগুলো টিকিয়ে রেখেছে, যা নাগরিক ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের জনবিরোধী ভূমিকা পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্কে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।

জনকেন্দ্রিক পুলিশিং ব্যবস্থার ভিত্তি
পুলিশ-জনতার সম্পর্ক একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এ সম্পর্ক সহনীয় ও সম্মানজনক স্থানে আনার জন্য একটি আদর্শ ভিত্তি বিবেচনা করা হয়ে থাকে, তা হলো–

১. বিশ্বাস ও পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা
২. জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা
৩. বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা ধারণ ও লালন

জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে নীতি-কৌশল
নীতিগত ভিত্তি, জনগণের সেবক, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সমতা, সমানতা ও ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও সুনাগরিক সুরক্ষা নৈর্ব্যক্তিক আচরণ, দুর্নীতি দমন নীতি, কৌশল, এলাকাভিত্তিক নিয়মিত ডায়ালগ, পুলিশের কমিউনিটি সেবা পদ্ধতি ব্যবহার, শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু করা ও সচেতনতা সৃষ্টি, পুলিশের আচরণ দক্ষতা বৃদ্ধি, জনগণের আনা অভিযোগ নিষ্পত্তি, প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, সুসম্পর্কের ফলাফল

জনকেন্দ্রিক পুলিশের কার্যপরিধি
বাংলাদেশে পুলিশ জনতার সম্পর্কের ক্ষেত্র বা প্রসঙ্গগুলো সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা এবং উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্ক নির্ধারণ করে কীভাবে পুলিশ ও জনতা একসঙ্গে কাজ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও মজবুত হবে। পুলিশ ও জনতার সম্পর্কের কিছু ক্ষেত্র–

সচেতনতা বৃদ্ধি, এলাকার পুলিশি কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্ত, জরুরি সেবা প্রদান, জন ও যান চলাচল নির্বিঘ্ন করা, মানবাধিকার ও সুনাগরিক সুরক্ষা, মাদক, সন্ত্রাস ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ প্রতিরোধ, সামাজিক ও ব্যক্তি এবং পারিবারিক সমস্যার সমাধান, থানাগুলো সেবাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং দ্রুত সাড়া দানে তৎপরতা প্রদর্শন, পুলিশিং শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সহায়তা, সামাজিক ও সংস্কৃতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, গৃহীত নীতি ও কৌশল পর্যালোচনা সংস্কার এবং কর্মসূচির উন্নতি, ক্রাইম সিন সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিজ্ঞানভিত্তিক ও ফরেনসিক তদন্ত ব্যবস্থাপনার দক্ষতা অর্জন

পুলিশ সংস্কারে নাগরিকদের ভূমিকা
বাংলাদেশের পুলিশ ব্যবস্থার চলমান সংস্কারে নাগরিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশের কাঠামো ও প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন হলেও এর পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা, আচরণ এবং সম্পৃক্ততায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি। জনগণকেন্দ্রিক পুলিশ বাহিনী কেবল তখনই সফল হতে পারে, যখন নাগরিকরা তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

নাগরিকদের ক্ষমতায়নের জন্য সুপারিশ
অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশে (০-১ বছর) নিয়মিত টাউন হল সভার আয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ ও পুলিশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনের জন্য স্থানীয় থানার উদ্যোগে নাগরিক-পুলিশ সংলাপ একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অবিশ্বাস এবং দূরত্ব ঘোচাতে এ সংলাপের উদ্দেশ্য হলো উভয়পক্ষের মধ্যে খোলামেলা যোগাযোগ তৈরি করা, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধানের জন্য যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত সংলাপ (টাউনহল সভা) আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষার্থী পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এ সভাগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যাগুলো শোনা এবং সমাধানের পরিকল্পনা করা, নাগরিকরা তাদের এলাকার অপরাধ, নিরাপত্তা, যানজট বা অন্য কোনো সমস্যা সরাসরি পুলিশকে জানাতে পারবে।

জনগণের উদ্বেগ এবং অভিযোগ মোকাবিলা করা
পুলিশ তাদের পদক্ষেপ এবং সীমাবদ্ধতাগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে, যা নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সহায়ক।

নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা
পুলিশ জনগণের আইনি অধিকার, অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি এবং আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করতে পারে।

আস্থা বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করা
নিয়মিত মুখোমুখি আলোচনার মাধ্যমে উভয়পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে উঠবে।

নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি
ইতোমধ্যে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে গত ১০ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনর্বহালের জন্য প্রতিটি থানা এলাকায় নাগরিক এলাকায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নির্দেশনাটি পুনর্মূল্যায়ন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ নিরাপত্তা কমিটি গঠনের ব্যাপারে বিবেচনা করা যেতে পারে।

শিক্ষাক্রমে পুলিশ বিষয়ক মৌলিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা
নাগরিক সচেতনতা তৈরির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুলিশ এবং নাগরিকদের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। এটি এক থেকে তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য বলে সুপারিশ করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।

নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব শেখানো
পাঠ্যক্রমে এমন মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যেখানে নাগরিক অধিকার, দায়িত্ব এবং পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা শিখতে পারবে। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সচেতনতা তৈরি করবে।

নাগরিকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগে শর্ট সার্টিফিকেট কোর্সের প্রস্তাব
নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে এবং জনগণকে দক্ষ ও সক্ষম করে তুলতে শর্ট সার্টিফিকেট কোর্স একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে। এ কোর্সগুলো নাগরিকদের আইনি অধিকার, দায়িত্ব এবং পুলিশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরির কৌশল শেখাবে। অনেক দেশে নাগরিকদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশেও অনুকরণ করা যেতে পারে।

শর্ট সার্টিফিকেট কোর্সের প্রস্তাবনা
ব্যক্তিগত অধিকার, পুলিশি কার্যক্রমের সীমা এবং অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি। পুলিশের সঙ্গে নিরাপদ এবং গঠনমূলক যোগাযোগের কৌশল। দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব এবং এটি প্রতিরোধে নাগরিকদের ভূমিকা। জরুরি পরিস্থিতিতে পুলিশের সাহায্য নেওয়া, নিরাপদ থাকা এবং সমন্বয়ের পদ্ধতি। অনলাইন, অফলাইন বা মিশ্র (হাইব্রিড) পদ্ধতিতে ১ থেকে ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ কোর্স পরিচালনা করা যেতে পারে।

এর লক্ষ্য হবে তরুণ প্রজন্ম (বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী), পেশাজীবী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতারা, সাধারণ নাগরিক যারা পুলিশি সংস্কার এবং সুশাসনে আগ্রহী করা।

এসএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন