পিএনএস ডেস্ক: দ্বিতীয় মেয়াদে পিটার বাটলারকে নারী ফুটবল দলের কোচ করায় নারী ফুটবলারদের একাংশ অসন্তুষ্ট। কোচের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্যে এসেছে। বাটলারকে কোচ হিসেবে রাখা হলে সিনিয়র নারী ফুটবলারদের প্রায় সবাই এক যোগে অবসরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
আজ সন্ধ্যায় বাফুফে ভবনের নিচে গণমাধ্যমের সামনে কোচের সঙ্গে দ্বন্দের বিষয়টি তুলে ধরেছেন নারী ফুটবলাররা। এসময় তিন পাতার একটি বিবৃতিতে বিস্তারিত বিষয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সাবিনা খাতুনরা।
জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সকল খেলোয়াড় অধিনায়ক সাবিনা, ডিফেন্ডার মাসুরা, শিউলি আজিম, মিডফিল্ডার সানজিদা, মারিয়া, ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা, শামসুন্নাহার, তহুরার সঙ্গে উঠতি তারকা সাগরিকা, স্বর্ণারাও ছিলেন। সব মিলিয়ে বাফুফে ভবনের নিচে প্রায় ১৫ জন ফুটবলার কোচের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন।
নারী ফুটবলারদের তিন পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
'প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
সালাম নেবেন। একটা ক্রান্তিকালে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। আপনাদের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ জেনেছে কতটা প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা টানা দুইবার দেশের মানুষের জন্য সাফ শিরোপা এনে দিয়েছি। এই পর্যায়ে আসতে আমাদের কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে, কত বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে, এ সবকিছুই আপনাদের জানা। গত বছর অক্টোবরে নেপালের কাঠমন্ডুতে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আরেকবার প্রমাণ দিয়েছি, আমরাই সেরা। সেই টুর্নামেন্ট চলাবস্থায় দলের কোচ পিটার বাটলারের সঙ্গে দলের খেলোয়াড়দের দূরত্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। ইচ্ছেমতো একাদশ গড়ে তিনি দলকে ডোবাতে চেয়েছিলেন।
পাকিস্তানের বিপক্ষে কোচের সিনিয়র ফুটবলারদের বাদ দেওয়া একাদশ যে ভুল ছিল, সেটা সবাই দেখেছে। কারণ, ওই ম্যাচ আমরা হারতে হারতে কোনোরকমে ড্র করেছিলাম। ভারতের বিপক্ষে আমাদের চাপে তিনি একাদশ বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সিনিয়রসমৃদ্ধ বাংলাদেশ দল ভারতকে হারিয়ে গ্রুপসেরা হয়েছিল। এটাই প্রমাণ করে আমরাই সঠিক ছিলাম। কিন্তু ওই ম্যাচে নামার আগেই জানতাম কোচের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহে এই একাদশ তৈরি হয়েছিল। আমরা যদি ব্যর্থ হই, বাফুফে কর্তারা এবং দেশের মানুষের কাছে আমরা ভিলেন হয়ে যেতাম। ওই ম্যাচেই আমাদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেত। এটা বুঝেও আমরা ঝুঁকি নিয়েছিলাম দেশের হয়ে লড়াই করার জন্য। দেশের জন্য আমাদের এই লড়াই ও আবেগ, ভালোবাসার মূল্য ফুটবল ফেডারেশন থেকে আশা করেছিলাম।
সেটা হয়নি। বরং সাফ থেকে ফেরার পর যা হলো, তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। এই বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে আরও দুই বছরের চুক্তি নবায়ন করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এই সিদ্ধান্তে মেয়েদের দাবি-দাওয়াকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বাটলারকে কেন আমরা কোচ হিসেবে চাই না? সেটা জানাতেই আমাদের আজকের প্রয়াস-
১. খেলোয়াড়দের সঙ্গে নেপালে ঘটে যাওয়া এতো এতো ঘটনার পরও কোচ পারতেন বিষয়টি সেখানেই সমাধান করতে। সাফ জিতে আসার পরপরই তিনি পারতেন আমাদের সঙ্গে বসতে। সেটা না করে বরং আমাদের উপেক্ষা করেছেন প্রতিনিয়ত।
সত্যি বলতে আমরা অবাক হয়েছিলাম এবং অপেক্ষায় ছিলাম যে উনি কখন মিটিং ডাকবেন। কিন্তু ডাকেননি। বাংলাদেশে এসে বাফুফের এক সহ-সভাপতি আমাদের ইস্যু নিয়ে কোচের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং ওনাকে ওনার ব্যবহার আচার সম্পর্কে সতর্ক হতে বলেন। আমাদের প্রশ্ন হলো, ওনাকে কেন সতর্ক করতে হবে? ওনার নিজের কি কোনো জ্ঞানবুদ্ধি নেই যে ওনার কি করা উচিৎ, কি করা উচিৎ নয়?
২. বাংলাদেশের নারী ফুটবলে এই ঘটনা একেবারেই প্রথম। একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কোচ ভুলে যান যে তার হাতে ৫টা পরিবর্তন আছে। সাফের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমরা যখন ১-০ গোলে হারার পথে, তখন প্রধান কোচ সানজিদাকে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নামানোর সময় দেখেন খেলোয়াড় বদলের কাগজ তার কাছে নেই। আগে তিনটা পরিবর্তন করায় সঙ্গে থাকা তিনটি কাগজই শেষ হয়ে গেছে। তখন ম্যাচের ৯৫ মিনিট চলে। যেখানে বাংলাদেশ ১-০ গোলে পিছিয়ে রয়েছে। তখনও বাংলাদেশের হাতে ২টা খেলোয়াড় পরিবর্তনের সুযোগ ছিল, কিন্তু কাগজ ছিল না। ব্যপারটা খুবই লজ্জাজনক ও হাস্যকর। এতো বড় ডিগ্রিধারী কোচের থেকে এটা আশা করা যায় না।
৩. ওই ম্যাচেই কৃষ্ণাকে নামানোর আগ মূহুর্তে এক সহকারী কোচ তার জার্সির নাম্বার জিজ্ঞেস করলে আরেকজন সতীর্থ খেলোয়াড় বলে দেয়। কৃষ্ণা তখনও সেভগার্ড পড়ায় ব্যস্ত থাকায় দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করেন জার্সি নাম্বার। আবারও অন্য সতীর্থ বলে দেওয়ায় কোচ রেগে কৃষ্ণার দিকে তেড়ে আসেন। মামুলি জার্সি নাম্বার না বলায় এরকম আচরণ কোনো কোচের পক্ষে সম্ভব কিনা আমাদের জানা নেই।
৪. কেবল মাঠ নয়, মাঠের বাইরেও প্রতিনিয়ত কোচ আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেন। দলের অভ্যন্তরে খেলোয়াড়দের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়রের কথা বলে বিভাজনের সৃষ্টি করেছেন। মেয়েদের পোশাক নিয়ে কথা বলতেও ছাড়েননি। বডি শেমিংও (অন্যের শারীরিক বৈশিষ্ট্য কিংবা অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য) করেছেন। মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেন, বাজে মন্তব্য করেন কোচ। আমাদের বিরুদ্ধে কোচ সব সময় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ করেন। এটা যে ডাহা মিথ্যা কথা, তার বড় প্রমাণ হলো, অতীতের কোনো কোচ মেয়েদের শৃঙ্খলা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি। পিটাররে এরকম উল্টাপাল্টা আরচণের বিষয়গুলো সহকারী কোচরাও জানেন। কিন্তু তারা চাকরি যাওয়ার ভয়ে মুখ খোলেন না।
৫. আমাদের সঙ্গে কোচ যা যা ঘটিয়েছেন, তা জানিয়ে আমরা বাফুফের মাননীয় সভাপতির কাছে গত বুধবার একটি চিঠি দিয়েছি। যে চিঠিতে আমরা লিখেছি, "আমরা একটি জটিল বিষয় আপনার নজরে আনতে লিখছি। কোচ পিটারের আচরণ দলের মধ্যে মারাত্মক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, যা একটি বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে ক্যাম্পে। এটা আমাদের খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গত ছয় মাসে, পিটারের কাছ থেকে আমাদের অনেক গালি-গালাজ শুনতে হয়েছে। আমাদের মানসিক হয়রানি ও উৎপীড়নের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন কোচ। তার কারণে ক্যাম্পে একটি আতঙ্ক বিরাজ করছে। খেলোয়াড়রাও তাতে ভীষণ অসম্মানিত ও হতাশার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে। খেলোয়াড়রা, বিশেষ করে দলের সিনিয়র সদস্যরা, ধারাবাহিক বৈষম্য ও অন্যায় আচরণের শিকার হচ্ছেন। কোচের এসব আচরণ কেবল অবমাননাকর নয়, দলগতভাবে পারফর্ম করার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করেছে। এটা মানতে হবে যে, কোচিংয়ে শুধুমাত্র কৌশল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলেই হয় না বরং পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস ও সমর্থনের পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষমতাও কোচের থাকতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত, কোচ পিটারের নেতৃত্বে খেলোয়াড়রা বিচ্ছিন্ন ও হতাশাগ্রস্ত বোধ করে, যা একটি বাজে সংস্কৃতি তৈরি করেছে।"
৬. আমরা কোনো অবস্থাতেই দলে বিভাজন চাই না। তাই বিভাজন সৃষ্টি করা কোচকেও আমাদের প্রয়োজন নেই। কোচ পিটার দলের কিছু জুনিয়র ফুটবলারকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন। কিছু মেয়েদের ব্যবহার করে মিথ্যাচারও করছেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, আমরা সিনিয়ররা নাকি জুনিয়র মেয়েদের চাপ দিচ্ছি যাতে তার অধীনে অনুশীলনে অংশ না নেয়। আমরা পরিষ্কার জানাতে চাই, আমাদের পক্ষ থেকে কাউকে কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। ভালো-মন্দের বিচার করার বয়স-জ্ঞান ক্যাম্পে থাকা প্রতিটি মেয়ের হয়েছে। সুতরাং, সবাই নিজ নিজ সিদ্ধান্তেই তাদের অবস্থান বেছে নিয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমরা আশা করছি, বাফুফের মাননীয় সভাপতি (তাবিথ আউয়াল) বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে আশু সমাধানের ব্যবস্থা নেবেন। এর আগ পর্যন্ত আমরা বাটলারের অধীনে কোনো অনুশীলন ক্যাম্পে অংশ নিব না। যেহেতু গত অক্টোবরের পর কোনো ফুটবলারের সঙ্গে বাফুফে কোনো চুক্তি নবায়ন করেনি, তাই আইনত বাফুফে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে না। তারপরও যদি সেরকম কিছু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং বাটলারকেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বাফুফে অনড় থাকে, তবে আমরা একযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হব। ভেবে নিব, দেশের নারী ফুটবলে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।
সবাইকে ধন্যবাদ।'
এসএস
কোচের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ নারী ফুটবলারদের
30-01-2025 09:26PM