পরোক্ষ ধূমপানে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে গর্ভের শিশু

  17-02-2018 10:26AM


পিএনএস ডেস্ক: গুলশানের এক বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত লামিছা রহমান। তিনি জানান, ‘তার স্বামী নিয়মিত মদ্যপান করতেন, তবে সেটা ছিল বাইরে। কিন্তু ঘরে প্রচুর ধূমপান করতেন। দিনে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ প্যাকেট। তিনি গর্ভবতী হওয়ার পরও স্বামী ধূমপান বন্ধ করেননি। সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়ায় লামিছার শ্বাস নিতে কষ্ট হতো, সারাক্ষণ মাথা ব্যথা লেগে থাকতো। এভাবে চললো ৩ মাস। একদিন পেটে প্রচুর ব্যথা হলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তিনি সুস্থ হলেও গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়।

চিকিৎসক জানালেন, ‘পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে গর্ভের ভেতরই মারা গেছে তার শিশুটি। চিকিৎসক তাকে এও জানালেন, ‘প্রতিনিয়ত অন্যের ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের শিশুটিও রেহাই পাচ্ছে না। পরোক্ষ ধূমপানে গর্ভস্থ শিশুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় গর্ভের প্রথম এবং শেষ তিন মাসে। যেমন- গর্ভপাত, অপরিণত শিশুর জন্ম, স্বল্প ওজনের শিশু, গর্ভকালীন রক্তস্রাব, প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, মৃত শিশুর জন্ম দেয়া ইত্যাদি।

বিশ্বে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব নিরূপণে প্রথমবারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)-এর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে বছরে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়। ঘরে বসে থেকেই এসব শিশুরা তারই পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে।

ডব্লিউএইচও’র এই গবেষণায় আরো উঠেছে, সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া ও এতে মিশে থাকা বিষাক্ত উপাদান গর্ভস্থ শিশুর বুকে এবং হাতে রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়। ফলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হতে পারে। ধূমপায়ী মহিলাদের ঠোঁটকাটা এবং তালুকাটা সন্তান জন্মদানের হার অন্যদের তুলনায় বেশি। মায়েদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব স্পষ্ট শিশুর জন্ম-পরবর্তী সময়েও। স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন শিশু, অমনোযোগী, অতি চঞ্চলতা, আচরণগত সমস্যা, লেখাপড়ার সমস্যার জন্যও দায় রয়েছে এর। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে হঠাৎ মৃত্যুও হতে পারে এসব শিশুর।

জাতীয় বক্ষব্যধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম লুৎফর রহমান বলেন, ‘সিগারেট বা বিড়িতে যে দূষিত পদার্থ রয়েছে ৭০ হাজারের মতো, যার ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে, সেটা তো বাচ্চারা পাচ্ছে এবং ধোঁয়া ছাড়ার সময় যে সমস্ত জীবাণু উনার মুখে বা শ্বাসনালীর মধ্যে রয়েছে সেগুলো উনি ত্যাগ করছে। সেগুলো ধোঁয়ার সাথে এসে বাচ্চার শ্বাসনালীতে সরাসরি চলে যাচ্ছে।’

‘বাবা- চোখ জ্বলছে, শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। ‘ধোঁয়ায় মাথা ঘুরাচ্ছে তো। ঘরে সিগারেট না খেলে হয় না?’ বাবার সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়ায় ৮ বছর বয়সী তাসনিমের শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় এভাবেই তার বাবাকে কথাগুলো বলছিলো। ফার্মগেট মনিপুরীপাড়ার এক বাড়ির চিত্র এটি। শিশু তাসনিমের মতো পরিবারের ধূমপায়ী ব্যক্তির বিষাক্ত ধোঁয়ার পরোক্ষ শিকার উচ্চ, মধ্য কিংবা নিম্নবিত্ত- সব শ্রেণীর অনেক পরিবারের নারী-শিশুকে প্রতিনিয়তই এমনই কষ্ট ভোগ করতে দেখা যায়।

এভাবেই চার দেয়ালের ভেতর এবং বাইরে যেমন- বাস, ট্রেন, লঞ্চ, জনবহুল স্থান কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারী-শিশুরা দেহের ভেতর ধূমপানের বিষ টেনে নিচ্ছে। আর আক্রান্ত হচ্ছে নানা মরণব্যাধিতে। তাসনিমের মতো শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানে স্থায়ীভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। প্রতিনিয়তই সিগারেটের ধোঁয়া কেড়ে নিচ্ছে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম শিশুদের জীবনী শক্তি। তবে পরোক্ষ ধূমপানে দেশে কতসংখ্যক শিশু ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাইমুল হক এই প্রতিবেদকে জানালেন, ‘গর্ভবতী থাকাকালীন অবস্থায় যদি মায়ের শরীরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিগারেটের ধোঁয়া যায় তাতে ভূমিষ্ট হওয়ার পর শিশুর শ্বাসতন্ত্রের রোগ থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী ক্যান্সারের মতো জটিল সব রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে এই ধারণাটি অনেক আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত উল্লেখ করে তিনি আরো জানালেন, এ ক্ষেত্রে একেবারে নতুন ধারণাটি হলো শিশুর প্রতিবন্ধী কিংবা অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সাথে মায়ের গর্ভাবস্থায় সিগারেটের ধোঁয়ার একটা যোগসূত্র রয়েছে। যে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বাংলাদেশের চিকিৎসকরাও। এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ধূমপানের হার অনেক বেশি। আমাদের দেশে অটিস্টিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চাও দেখা যাচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, শিশুর মানসিক রোগ থেকে শুরু করে অপুষ্টি সবকিছুর পেছনেই রয়েছে ধূমপায়ীর সিগারেটের প্রভাব। শিশুর মানসিক অসুখের সাথে সিগারেটের ধোঁয়ার যোগসূত্র আছে কি-না সে বিষয়েও রয়েছে নানা গবেষণা। এদিকে, স্পেনের এ রকম এক গবেষণা দেখা গেছে, যেসব বাসায় ধূমপান করা হয় সেসব বাসায় শিশুদের অস্থিরতাজনিত মানসিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা ৩ গুণ বেশি। কেবল তাই- নয় ওইসব শিশুরা রীতিমত অন্যের সিগারেটের ধোঁয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবি তাদের হাসপাতালে বেশ কয়েক বছর ধরে ভর্তি হওয়া শিশুদের বিশ্লেষণ করে পেয়েছে যে, যেসব শিশুর বাবা বাসায় নিয়মিত ধূমপান করে তারা তুলণামূলকভাবে বেশি অপুষ্ঠিতে ভোগে।

ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-এর ব্যবস্থাপক ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঞা বলেন, ‘তামাক গ্রহণ করার ফলে দেখা যায় যে, মানুষের মধ্যে একটা ক্ষুধামন্দা তৈরি হয়। এই ক্ষুধামন্দাটা স্বাভাবিকভাবে বাচ্চাদের মধ্যেও তৈরি হতে পারে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিশ্লেষকরা জোর দিচ্ছেন ব্যাপক সচেতনতা এই আইনি প্রয়োগের ওপর।

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, ধূমপান না করেও পরোক্ষভাবে শিশুরা মারাত্মকভাবে স্থায়ী ক্ষতির শিকার হচ্ছে। পরবর্তী জীবনে তাদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে শিশুদের হাঁপানি, ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দিতে আক্রান্ত হওয়া, ঘুমের মধ্যে মৃত্যু, মেনিনজাইটিস ও কানের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শিশু বেড়ে ওঠার ২০ বছর পরই এসব রোগের উপসর্গগুলো ধরা পড়ে।

মানস’র তথ্য মতে, ঘরের একটি কক্ষ কিংবা লঞ্চ, বাস, ট্রেনের বগি বা কক্ষের বাতাসের ৮৫ শতাংশ ভরে থাকে ধূমপায়ীর ছোড়া ধোঁয়ায়।

বিশ্লেষকদের মতে, বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানে হৃদরোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রকোপ ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। আর কর্মস্থল এবং পথে-ঘাটে পরোক্ষ ধূমপানে হৃদরোগের হার বেড়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।

গবেষকদের মতে, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে ২৫টি প্রাণঘাতী রোগের প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তামাক বলতে শুধু বিড়ি বা সিগারেট সেবনকে বুঝায় না। পানের সঙ্গে জর্দা, সাদা, গুল, খৈনি, নার্সি ইত্যাদিকেও বুঝায়। পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে নারীর ক্ষতির বিষয়টি গবেষকদের কাছে অত্যন্ত উদ্বেগের। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা খুবই ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন