ত্রাণ চাই না বাঁধ রক্ষা করুন

  24-06-2018 12:21AM

পিএনএস (আব্দুস সোবহান, কুলাউড়া প্রতিনিধি): ঘর নাই। ক্ষেত নাই। ২-৪ কেজি চাল আর নুন-তেল দিয়ে কি হবে? বারবার নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙে। প্লাবিত হয় পুরো জেলা। এ নিয়ে কয়েকদিন হৈ চৈ হয়। এরপর যেই-সেই।

বাঁধ ভাঙলে অনেক বড় ব্যক্তিরা আসেন। পরিদর্শন করেন। নানা বড় বড় আশ্বাসও দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বন্যাকবলিত হলে আমাদের জন্য বরাদ্দের কথা শুনি। কিন্তু এত বরাদ্দ যায় কোথায়? আগে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ কম ভাঙলে এখন দেখছি প্রতি বছরই ভাঙছে। যে বছর নতুন বাঁধ হয় ওই বছরই দেখা দেয় ভাঙন। আর আমাদের ক্ষেতকৃষি, ঘরবাড়ি সহায় সম্বল সবই গ্রাস করে পানি। বারবার বাঁধ ভেঙে আকস্মিক বন্যায় আমরা এখন নিঃস্ব। আমরা আর ত্রাণের নামে ফটোসেশন মার্কা ভিক্ষা নিতে চাই না। আমরা আমাদের ঘরবাড়ি আর ক্ষেতকৃষিকে অবলম্বন করে বাঁচতে চাই। সরকারের কাছে ত্রাণ নয় এই দয়া ভিক্ষা চাই। গতকাল দুপুরে হতাশা আর ক্ষোভে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই কথাগুলো বলছিলেন আকস্মিক বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ধলাই নদীর তীরবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের করিমপুর, বাদে করিমপুর, সোনান্দপুর, মইডাইল, জলালপুর ও মনুনদীর তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের সঞ্জবপুর, হরিপুর, খিজিরপুর, বাগজুর, লালারচক, ইটারঘাট তেলিবিল, চাতলারঘাটসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের দুর্ভোগে থাকা লোকজন। ইটারঘাট এলাকার মঈন উদ্দিন ও আবুল কালাম,সঞ্জবপুরের আব্দুর রশিদ, বাগজুরের করিম মিয়া, লালারচকের ঈসমাইল আলী ও হোসেন মিয়া, ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মখদ্দছ আলী আর মইডাইল গ্রামের রেহমান মিয়া,হাসান মিয়া, সোনান্দপুরের শানুর মিয়া ও আব্বাস মিয়া,বাদে করিমপুরের ঈমান উল্লাহ ও মায়া বেগমসহ অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারা ক্ষোভ ও হতাশায় বলেন প্রতিবারই নদী ভাঙে বন্যা হয়। আর আমরা মানবেতর জীবন যাপন করি। কিন্তু আমাদের এই সমস্যা স্থায়ী লাগবে কেউ উদ্যোগী হয় না। এভাবে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষেতকৃষি ছেড়ে ভিক্ষায় নামতে হবে। তারা বলেন, ত্রাণে ধনীরা ধনী হয়। চোখের সামনে তা দেখে মানুষিক যন্ত্রণা বাড়ে। আমরা আর ত্রাণ চাই না। দয়া করে আমাদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তি দিন। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন আমরা ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা উত্তাল নদীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে চাই। আমাদের বাঁচান। এ বছর ১৩ জুন নদী শাসনের বাঁধ ভেঙে আকস্মিক বন্যায় জেলার মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাদের ভর করে দুর্ভোগ। বানের পানিতে তলিয়ে যায় ঘরবাড়ি আর ক্ষেতকৃষি। সবই গ্রাস করে বানের পানি। গেল বছরের মতো এ বছরও দেখা দেয় বন্যা। আকস্মিক বন্যায় সব হারিয়ে নদী তীরের বাসিন্দারা এখন নিঃস্ব। সরকারি তরফে বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দিলেও মিলেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ। এ নিয়ে বানভাসি মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই বন্যার্তদের দুর্দিনে এগিয়ে এসেছেন। তবে বানভাসিরা এমন নাম ফাটানো ফটোসেশনের ত্রান নিতে আগ্রহী নয়। তারা নদী শাসনে স্থায়ী পদক্ষেপ চান। এ বছরের আকস্মিক বন্যায় কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী প্রায় ৪০টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার ৫ শতাধিক গ্রামের ৪ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। হঠাৎ নদীর বাঁধ ভাঙা পানির তোড়ে মানুষের বসত ভিটার সঙ্গে আশ্রয় হারায় হাঁস, মোরগ, গরু, মহিষসহ গৃহপালিত পশুও। ভেসে যায় ৫ শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামার। মনু নদীর বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার পৌর শহরের ৩টি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়। এমন আকস্মিক বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েন শহরের বন্যাকবলিত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও অফিস পাড়ার লোকজনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সড়কগুলোতে হাঁটু থেকে কোমর পানি থাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা মনে করেন নদী খনন ও শুষ্ক মৌসুমে পরিকল্পিতভাবে সংস্কার কাজ না করাসহ ওয়াপদা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফলতির জন্য তাদের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগ। বছরে বছরে ভেঙে যাওয়া নদীতীর রক্ষা বাঁধ গুলোর সংস্কার কিংবা স্থায়ী ভাবে বাঁধের কাজ না করায় তাদের এই চরম খেসারত। তবে স্থানীয় ওয়াপদা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন সাধ্যানুযায়ী দুর্ভোগ লাগবে তারা যথেষ্ট আন্তরিক। এ বছর উজান থেকে ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি পানি আসায় তা উপচে পড়ে বাঁধ ভেঙেছে। জানা যায় এবছর ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের অত্যন্ত ৩৫-৪০ টি স্থান ভাঙ্গন ও ভাঙ্গার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মোত্তালিব তরফদার বলেন ওরা বার বার বাঁধ দেয়। আর বার বার ভাঙে। তা হলে তারা কি বাঁধ দেয়? আমার ইউনিয়বাসী আর অযাচিত বন্যাদুর্গত হয়ে ত্রাণ নিতে চায় না। নদী শাসন ও বাঁধ রক্ষায় স্থায়ী সমাধান চায়। কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জুনাব আলী বলেন, প্রতি বছরই আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। তখন সরকারি তরফে কিছু ত্রাণ দিয়েই সব দায়-দায়িত্ব শেষ। অথচ বন্যাকবলিত মানুষের কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। নিঃস্ব হওয়া বন্যার্তরা বন্যা-পরবর্তী আবার নতুন করে জীবন-সংসার শুরু করেন। বছর বছর তারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন চরম অসহায়। তিনি বলেন, আর ত্রাণ নয়। নাব্যহ্রাস হওয়া নদীগুলোর খনন ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পরিকল্পিত নদী শাসনে সরকারের এগিয়ে আসার আকুল আবেদন ক্ষতিগ্রস্ত ভানবাসি মানুষের। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, এ জেলার নদী তীরবর্তী মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলায় নদী শাসনে স্থায়ী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। জেলার নদী ও হাওর গুলোর নাব্যহ্রাস ও প্রতিরক্ষা বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত থাকায় ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা ঢলে ধারণ ক্ষমতার অধিক পানি হওয়ায় তা উপচে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। বন্যাকবলিত হয় পুরো জেলা। তিনি বলেন, সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। যেহেতু এটি একটি বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প তাই হয়তো নানা চিন্তাভাবনায় এগুতো হচ্ছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন