সাবেক ইসি’র বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে দুদক

  17-01-2025 09:22AM

পিএনএস ডেস্ক: আওয়ামী লীগের শাসনামলের তিনটি জাতীয় নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত। একতরফা ও জালিয়াতির এসব নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা নেয়া হয়েছিল মাত্র। এই নির্বাচনগুলোতে ছিল না জনসমর্থন। এসব নির্বাচন আয়োজনে বড় ভূমিকা ছিল নির্বাচন কমিশনের। জনআপত্তি উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কমিশন সরকারের পক্ষে নির্বাচন আয়োজন করে।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে শামিল হয়েছিল তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করে একটি দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অভিযোগের তীর সাবেক তিন কমিশনের সিইসি ও ইসিদের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগে এবার তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহের যেকোনো দিন নিয়মিত সভায় সাবেক সিইসি ও ইসিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সূত্র বলছে, জাতীয় নির্বাচনে কি কি অনিয়ম হয়েছে সেসব খোঁজ নেয়া শুরু করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ তছরুপের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অন্যদিকে সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সম্পদের তথ্যও জানতে চাওয়া হবে।

দুদক সূত্র আরও জানায়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে নির্বাচনে ব্যবহার করা ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতামতের ঊর্ধ্বে গিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের অনুমোদন দেন। এসব মেশিন একপর্যায়ে অকেজো হয়ে পড়ে। হাজার কোটি টাকায় কেনা ইভিএম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ ক্ষতির বিষয়টিও অনুসন্ধানের আওতায় আসতে পারে বলে দুদকের ওই সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দুদকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা সঙ্গে আলাপকালে জানান, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম দুর্নীতি কী পরিমাণ হয়েছে এবং এর মধ্যদিয়ে সিইসি-ইসিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধনের বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের পরিকল্পনা রয়েছে দুদকের। তিনি বলেন, পরিকল্পনামাফিক অনেক কাজই দুদক করছে। গত ১৬ বছরে যেসব সেক্টরে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে সবই আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করার চিন্তা করছে। আইন অনুযায়ী সাবেক সিইসি-ইসিদের কোনো অপরাধ প্রমাণ পেলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, শুধু সাবেক সিইসি-ইসিরাই নন। বিতর্কিত নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপের মতো অনিয়ম করা সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হতে পারে। তবে এটা বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ। এখানে কে কোন ভূমিকা পালন করেছেন কীভাবে অনিয়ম হয়েছে সব বের করা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

দুদক জানায়, গত তিনটি নির্বাচনে মোট কতো কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবং কোনো অর্থ বিনা কারণে খরচ হয়েছে কিনা এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে একটি টিম খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছে। যা কমিশনের শুরু হতে যাওয়া অনুসন্ধানটি আরও বেগবান করবে।

এ বিষয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ইসি সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তিনটি নির্বাচন বিতর্কিত ছিল এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটি পক্ষকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। গত নির্বাচনেও ২২শ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। নির্বাচনে কি কি অনিয়ম হয়েছে সেটা নিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াধীন।

কোন নির্বাচনে কতো টাকা বাজেট ছিল: ২০১৪ সালের প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ভোটে কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন ব্যয় করেছিল ২৬৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশন সে ব্যয় বাড়িয়ে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে। যদিও নির্বাচনে ব্যয় বেড়েছিল আরও বেশি। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২৪ সালে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের আমলে নজিরবিহীন ব্যয় হয়। এতে নির্বাচনের জন্য খরচ হয় প্রায় ২৩শ’ কোটি টাকা।

যেমন ছিল তিনটি নির্বাচন: ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার আড়াই বছর পর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১২৫, জাতীয় পার্টি (জাপা) ২২, জাসদ ২, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জেপি ১ এবং তরীকত ফেডারেশন একটি আসনে বিনা ভোটে জয়ী হয়। বাকি ১৪৭ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়। দিনভর কেন্দ্র ফাঁকা থাকলেও ভোটের হার দেখানো হয় ৪০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

‘রাতের ভোট’ খ্যাত ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। সেই নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরা হয়। অস্বাভাবিক ফলাফলের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং বিএনপি ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে দেখানো হয়। বিএনপি পেয়েছিল ছয়টি আসন। আওয়ামী লীগ ২৫৮ ও জাতীয় পার্টি ২২ আসন পায়।

একাদশ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার দেখানো হয় ৮০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যদিও রাতের বেলায় বাক্স ভরার অভিযোগে নির্বাচনের দিন সকালে শতাধিক আসনে ভোট বর্জন করেন বিএনপি নেতৃৃত্বাধীন ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থীরা। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, ১০৩ আসনের ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫ কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়ে ৬ হাজার ৪৮৪ কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়ে ১৫ হাজার ৭১৯ কেন্দ্রে, যা ছিল অস্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের শতাধিক প্রার্থী ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বলে দেখানো হয়।

তখন থেকেই প্রচলিত কথা ছিল রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নির্বাচনের আগে ব্যালটে সিল দিয়ে ভোটবাক্স বোঝাই করে পুলিশ। যদিও কে এম নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ সেই অভিযোগ নাকচ করে।

অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারিতেও বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগ ডামি প্রার্থী দেয়। নিজ দলীয় নেতাদের মধ্যেই ভোটের আয়োজন করে। সে নির্বাচনের বৈধতা দেন তৎকালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন