ডুবন্ত ফারমার্স ব্যাংক উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণ হচ্ছে

  29-03-2018 02:19PM


পিএনএস ডেস্ক: বিভিন্ন অনিয়মে ডুবতে থাকা নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের বিপর্যয় কাটাতে এবার এক হাজার ১০০ কোটি টাকার তহবিল জোগান দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটির মালিকানা অংশীদারিত্ব দেয়া হবে পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। গতকাল গভর্নরের সাথে বৈঠকে এ বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে, কোন প্রতিষ্ঠানকে কতটুকু মালিকানা ছেড়ে দেয়া হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ার পর অনেকটাই তহবিল শূন্য হয়ে পড়েছে ফারমার্স ব্যাংক। কার্যক্রম শুরু করার চার বছরের মাথায় ডুবতে বসছে ব্যাংকটি। অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এর ফলে ব্যাংকটির তীব্র তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়। গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না ব্যাংকটি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যাংকটির এমডিকে অপসারণ করে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে। কিন্তু এতেও তারল্য সঙ্কট কাটছে না। প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না ব্যাংকটি।

এ দিকে গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি, বেসরকারি কোনো গ্রাহকের অর্থই ফেরত দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের ঢাকার বিভিন্ন শাখায় রাখা জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডের মোট ৫০৮ কোটি ১৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা ফেরত দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

এদিকে, গত এক বছর যাবত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না ব্যাংকটি। ক্রমগতভাবে সিআরআর ঘাটতির ফলে ইতোমধ্যে ব্যাংকটিকে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ৩ জুন ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে ব্যাংকটি। কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ নিয়ামাচার পরিপালনে এবং ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় শিথিলতা দেখা দেয়। ফলে ব্যাংকটিতে বিভিন্ন অনিয়ম সংঘটিত হতে থাকে। মোটা দাগে ১৩টি বিশেষ অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত না করে গ্রাহকদের উদ্দেশ্য বহির্ভূত খাতে অর্থ স্থানান্তরে পরোক্ষ সহায়তা করা হয় ব্যাংক থেকে। অস্তিত্ববিহীন ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। ঋণ নিয়ামাচার লঙ্ঘন করে ব্যাংকের পরিচালকসহ অন্য ্ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ প্রদান করা হয। অপর্যাপ্ত ও ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতে ঋণ প্রদান ও খেলাপি গ্রাহকের বিপরীতে ঋণ প্রদান করা হয়। এভাবে ১৩টি অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংক তারল্য সংকট রয়েছে। বর্তমানে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকের মূল তারল্য পরিমাপক সূচক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। যেমন গত এগ্রিল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যাংকটি একটানা সিআরআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়াও, গত জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি বেশ কয়েকদিন এসএলআর সংরক্ষণেও ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করার আশংকা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকটির পরিচালনায় যথাযথ নিয়মাচার অনুসরণ না করায় আয়ের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত বছরের জুনের পর হতে একমাত্র গত ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক ছাড়া ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। গত জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির নীট লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টিই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির মোট শাখার ৫০ শতাংশের বেশিই লোকসানী।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নিয়মের বাইরে বেশি ঋণ দিয়ে এসব ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকটিতে বড় ধরণের তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে। এদিকে, এখন আর আমানত সংগ্রহে সাড়া পাচ্ছে না ফারমার্স ব্যাংক। উপরন্তু সাধারণ গ্রাহক আমানত তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

এখন ব্যাংকটি চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে ডুবন্ত ফারমার্স ব্যাংক জাগাতে মূলধন যোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর ফজলে কবিরের উপস্থিতিতে এ বৈঠক হয়।

বৈঠকের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন দেড় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন রয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। বাকি এক হাজার ১০০ কোটি টাকা জোগান দেয়ার জন্য সরকারের ইঙ্গিত রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গতকালের বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটির মালিকানা বড় একটি অংশ ছেড়ে দেয়া হবে। তবে, কোন ব্যাংককে কী পরিমাণ মালিকানা দেয়া হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরো কয়েকটি বৈঠকের প্রয়োজন হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। সূত্র: নয়া দিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন