সাধারণ জীবনের অসাধারণ গল্প

  18-05-2018 04:44PM

পিএনএস, মারুফ রহমান : মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। গানের এই লাইন দুটির সাথে আমরা অনেক পরিচিত। কিন্তু বাস্তবে খুব কম মানুষের জীবনেই এই কথাটির প্রতিফলন দেখা যায় না। বাস্তবে আমরা সবাই নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, অন্যের ভাল-মন্দের খেয়াল রাখার সময় আমাদের নেই। তবে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় অসহায় মানুষের উপকার করা যেখানে বিত্তবানদের সবচেয়ে বড় প্রচারণা, সেখানে কিছু সাধারন মানুষ এখনো নিরবে নিভৃতে অসহায়ের অবলম্বন হয়ে আছেন। এমনই একজন মানুষ টাংগাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক আসাদুজ্জামান টিটু।

আব্দুল্লাহর পাশে : শুধুমাত্র আত্মতৃপ্তির জন্যই তিনি বেছে নিয়েছেন মানবতার সেবার পথকে। শিক্ষিকা স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ের পাশাপাশি তার পরিবারের আরো একজন সদস্য হচ্ছে শিশু আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহ স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না, হুইল চেয়ারে বসে চলাফেরা করে। অন্যসব সাধারণ শিশুর মত তার স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধি হয়নি। আব্দুল্লাহর বাবা জয়নাল, পেশায় একজন চা দোকানদার। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার অভাবের সংসার। বছর দুয়েক আগে বাবার চায়ের দোকানে টিটুর সাথে পরিচয় হয় আব্দুল্লার। একটু যত্নবান হলে এই মানসিক ও শারিরিক ভারসম্যহীন এই শিশুটিও স্বাবলম্বী হতে পারে সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তাই পুলিশ প্রধানের নিকট থেকে আইজি’জি ব্যাচ বাবদ পুরষ্কার স্বরূপ প্রাপ্ত কিছু টাকা দিয়ে তিনি আব্দুল্লাহকে একটি হুইল চেয়ার কিনে দেন। পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিত্সা ও তাকে স্বাবলম্বী করার বেশ কিছু উদ্যোগ নেন।



প্রতিদিন বিকেলে আব্দুল্লাকে সময় দেওয়া : পুলিশের ব্যস্ততম দায়িত্বের পাশাপাশি প্রতিদিন বিকেলে আব্দুল্লাকে সময় দেন টিটু। বাবার চা স্টলের সামনে তাকে পন্য বিক্রির হিসাব নিকাশ শেখান এবং শারীরিক অক্ষমতার জন্য কিছু ব্যায়ামে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেন। সেই সাথে তিনি আব্দুল্লাহর জন্য পড়ালেখার জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। ফলে ধীরে ধীরে আব্দুল্লার অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আব্দুল্লাহ এখন হিসাব করতে পারে এবং কত টাকা বিক্রির পর কত ফেরত দিতে হবে সেটা বলতে পারে। কয়েক দিন আগেও আব্দুল্লার পৃথিবী ছিল ঘরের চার দেয়াল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আর এখন আব্দুল্লাহ ফেসবুকে দেশ-বিদেশের খবর রাখতে পারে। আব্দুল্লাহ নিজের দেশ, প্রধানমন্ত্রী, রাজধানী ও জেলার নাম বলতে পারে। আব্দুল্লাহ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। তার মনে স্বাদ জাগে নিজের জেলাটি ঘুরে দেখার। সে নিজের দেশ সম্পর্কেও জানতে চায়। তার সামনে কোন অনাকাঙি্ক্ষত ঘটনা ঘটলে জিজ্ঞাসা করে, এটা কেন হল?

আব্দুল্লার পৃথিবীটা প্রতিনয়ত বড় হচ্ছে : পুলিশ অফিসার টিটু ভায়ের হাত ধরে আব্দুল্লার ছোট পৃথিবীটা প্রতিনয়ত বড় হচ্ছে। হয়তো, একদিন এই প্রতিবন্ধী শিশুটিও তার বাবার চা স্টলের হাল ধরতে পারবে। বাবার অবর্তমানে ছোট বোন ও মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবে। তবে সারাদিন আসামীদের নিয়ে কাজ করার পরও শিশু আব্দুল্লার প্রতি টিটু ভায়ের এই সদয় দৃষ্টি ভঙ্গী একদিনে তৈরী হয়নি। তার সাথে এবিষয়ে কথা বলে জানা যায়, তিনি সমাজকল্যানে স্নাতক পড়াকালীন সময় থেকেই তার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এসেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি চর্চা করেছেন সমাজ কল্যাণের। তারই অংশ হিসেবে তিনি বিভিন্ন সময় অসহায় মানুষের পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি তার মতে, পুলিশ যেহেতু জনগন তথা সমাজের সেবামূলক একটি বিভাগ। তাই সমাজকল্যান বিষয়ক নানা জ্ঞান নিয়েই সবার এই বাহিনীতে যোগদান করা উচিত্। তিনি সমাজের অসহায় মানুষদের বস্তুগত বা আর্থিক সহায়তা করার চেয়ে আত্মনির্ভশীল করে তোলাই শ্রেয় বলে মনে করেন। এর ফলে সেই অসহায় মানুষটিকে সারাজীবন কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। তাই তিনি আব্দুল্লাহকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলছেন। এজন্য তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন। আব্দুল্লার সাথে সাথে তিনি শহরের আরও একজন প্রতিবন্ধী শিশুর দায়িত্ব নিয়েছেন। আর এই কাজে তাকে সবচেয়ে উত্সাহিত করেন তার শিক্ষিকা অর্ধাঙ্গিনী।

মানুষ যেখানে আত্মতৃপ্তির জন্য অনেক টাকা খরচ করে দেশের বাইরে বেড়াতে যায়, সেখানে নিজ পেশায় আপোষহীন একজন সাধারণ মানুষ আত্মতৃপ্তির জন্য মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মানুষের উপকারের জন্য অনেক ধনী হতে হয় না। এজন্য প্রয়োজন শুধু সুন্দর একটি মানসিকতা, যার প্রমাণ টিটু ভাই। জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর পুলিশ বাহিনীর কঠোর দায়িত্বের মাঝেও তিনি তার সমাজ কল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানকে ভুলে যাননি। সমাজের অসহায় মানুষদের প্রতি টিটু ভায়ের এই সুন্দর মানসিকতা একটি আদর্শ। তিনি পুলিশ বাহিনীর এক উজ্জ্বল উদাহারণ। তার মত প্রতিটি মানুষই যদি এমন মানসিকতার হত, তবে হয়ত আমাদের সমাজে অসহায় মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকত। প্রত্যেক মানুষের মনেই এই ধরনের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, প্রতিটি মানুষই হোক অসহায়ের পথপদর্শক।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন