গুলিতে মৃত্যু: আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ

  15-03-2016 06:34AM



ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এটি একটি অসাধারণ রচনা। কিন্তু নিবন্ধটি এটাও প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষটি কতটা অসহায়। ওবামা তার প্রেসিডেন্সির মেয়াদকালে বিষয়টি পরিবর্তন হবে এমন আশা করেননি। কিন্তু তিনি আমেরিকার জনগণকে এই বার্তাটি দিতে চেয়েছেন। বার্তাটি হলো-

‘অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন যে সমর্থন করবে না আমি তার জন্য কোনো প্রচারণা চালাবো না, তাকে ভোট দেবো না বা সমর্থনও করবো না- এমনকি তিনি যদি আমার দলের প্রার্থীও হয়ে থাকেন। এবং যদি ৯০% আমেরিকান অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন সমর্থন করে তাহলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত নেতা নির্বাচন করতে পারবো’। সবশেষে, তিনি আমেরিকার জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমাদের সকলেরই দায়িত্ব আছে’।
বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশ হলেও আজ আমেরিকার মতো একই সমস্যার সম্মুখীন আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি। প্রত্যেক বছর কয়েক হাজার আমেরিকান বন্দুকের গুলিতে মারা যায়।

একইভাবে, বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জানিয়েছে, গত বছর বাংলাদেশে ৬৪ জন গুম হয়েছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৮৫ জন এবং আরও ১৯৭ জন রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন।

প্রধানত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এসব গুম ও হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। যদিও অরাজনৈতিক ও তুচ্ছ কারণেও অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। প্রায় সবক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং হত্যার শিকার ব্যক্তির মরদেহেরও কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য চরম লজ্জাজনক। মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের সমাজের প্রধান সমস্যা। একসময় আমাদের সমাজব্যবস্থা ছিল উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন ও সংবেদনশীল। অল্প কিছুদিন আগেও সমাজের মানুষগুলো রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে শিষ্টাচারের চর্চা করতো।

এখন আমাদের সমাজে আর এসবের কোনো মূল্য নেই। যদিও প্রত্যেকটা দেশে সমাজে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী কিন্তু আমাদের দেশের পরিবর্তনটি সহজবোধ্য ও ভীতিকর। সবকিছুর জন্য সরকারকে দায়ী করার প্রবণতা আমাদের মজ্জাগত এবং এটা সব সময় সঠিক নয়। সরকারের দায়-দায়িত্ব বেশি হলেও জনগণকেও তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে।

গত বছরের ৩১শে অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। খবরটি স্তম্ভিত করে দেয়ার মতো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি স্তম্ভিত হয়েছি দীপনের বাবার প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বলেন, ‘আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই না। কারণ, আমি জানি বিচার পাবো না’। একজন সন্তানহারা বাবার এমন সাহসী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে সম্ভবত এটাই প্রথম। সম্ভবত এটা ছিল আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি তার নীরব ধিক্কার। অব্যাহত সহিংসতা ও সন্ত্রাস এবং অপরাধীদের বিচার না হওয়ার কারণে আমাদের সমাজে অনেকেই অসহায়বোধ করেন। কিন্তু আমরা অসহায় নই, আমরা প্রতিরোধ করতে পারি এবং অবশ্যই করবো। প্রত্যেক সমস্যারই সমাধান আছে, প্রত্যেকটি বিপর্যয়ের যথাযথ জবাব আছে। আমরা সব বাংলাদেশি সাহসে বলীয়ান হয়ে একটি সমাধান বের করতে পারি। আমরা পূর্বের ন্যায় এখনো প্রাণোচ্ছল জাতি। অতীতে আমরা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এবং গণতন্ত্রের জন্যও যুদ্ধ করেছি। অধিকাংশ বাংলাদেশি এখনও ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতাকে আরও শাণিত করতে হবে। জনগণের শক্তি দুর্দান্ত শক্তি। যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়, এই শক্তি হয়ে ওঠে অজেয়। গুম ও হত্যার সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ করে সাধারণ নিরপরাধ মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টায় এগিয়ে আসার মতো মহৎ কাজ আর কী হতে পারে? রাজনৈতিক ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সমর্থনে সব বাংলাদেশির এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। গণমাধ্যমে আমরা সবাই ভুক্তভোগীর সন্তানদের দেখি। গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর হত্যার শিকার পারভেজ হোসেনের কন্যা রিদি হোসেনের মর্মস্পর্শী কান্না সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে কাঁদতে কাঁদতে সে জানায়, ‘আমি আব্বুর সাথে স্কুলে যেতে চাই। মায়ের কাছে টাকা নেই, আমাকে চকোলেট কিনে দিতে পারে না’। রিদি এখনও বোঝে না তার বাবা আর কখনোই ফিরে আসবে না। যখন এ পরিবারটি জানতে পারে নিহত স্বজনের লাশটিও তারা পাবে না তখন তাদের মানসিক অবস্থা কিরূপ হতে পারে একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারে না। অল্প কিছু ‘সৌভাগ্যবান’ পরিবার এখন পর্যন্ত তাদের স্বজনের লাশ পেয়েছে।

জাতি হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এই অমানবিক ও নারকীয় তাণ্ডবের প্রতিবাদ করা। নৈতিকতার সাহসে বলীয়ান হয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের উচিত আজ সামাজিক আন্দোলনে যোগ দেয়া। আসুন, আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই তারা যেন অপরাধীদের দলে জায়গা না দেন। আসুন আমরা সব সংসদ সদস্য, সরকারি আমলা, বিরোধীদল ও সাধারণ নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। এটা জাতীয় সমস্যা এবং সকল দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। আসুন আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বসবাসের জন্য নিরাপদ ও উপযোগী করে তোলার চেষ্টায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করি।
লেখাটি আল-জাজিরা থেকে অনূদিত



পিএনএস/বাকীবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন