মোস্তাফিজ হারিয়ে যাননি, যেতে পারেন না!

  23-01-2018 08:52PM

পিএনএস ডেস্ক : ‘আনপ্লেয়েবল’ শব্দটা এক শব্দে বাংলা করা কঠিন। ঠিক ততটাই কঠিন এই মোস্তাফিজকে খেলা। আর তার চেয়ে কঠিন এই মোস্তাফিজকে বর্ণনা করা। জিম্বাবুয়ে অবশ্য আপত্তি করতে পারে। বলতে পারে, ব্রাদার, আপনারা তো লিখেই খালাস। খেলতে তো আমাদের হচ্ছে, নাকি! কারণ এই মোস্তাফিজ যে সেই মোস্তাফিজ!

কোন মোস্তাফিজ? যে মোস্তাফিজকে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ একবারে আন্তর্জাতিক ম্যাচে এনে নামিয়ে দিয়েছিল হুট করে। এর আগে ক্রিকেট মহলেই তাঁকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা ছিল না, আগমনী বার্তা ছড়াননি জোরেশোরে। অচেনা, অখ্যাত; গ্রামের সবুজ গন্ধমাখা এক কিশোর। মুখে সারল্যমাখা হাসি। শরীরী ভাষাতেও নেই খুনে আগুন। বোলিং অ্যাকশনে নেই পেসারদের তেজ।

অথচ সেই মোস্তাফিজ যখন অভিষেক টি-টোয়েন্টিতে বোলিং করলেন, এ যেন ঢোঁড়া সাপের খোলসে থাকা গোখরার বিষ! সুন্দরবনের কোলঘেঁষা গ্রাম থেকে আসা তরুণ যেন সবুজ বনের মতো। বাইরে থেকে যতটা শান্ত আর সবুজ লাগুক, ভেতরে কিন্তু বেঙ্গল টাইগারের বাস!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চমকে দিয়ে হাজির হওয়া মোস্তাফিজ আইপিএল মাতিয়ে ইংলিশ কাউন্টিও জয় করতে গেলেন। সাফল্য পোষ মানা বিড়ালের মতো ঘুরঘুর করছে পায়ে। হঠাৎই চোট, তারপর থেকে তিনি নিজেই যেন উপভোগ করছিলেন না নিজের বোলিং! তারপর কত কথা। সমর্থকদের মনে কু-ডাক। তবে কি মোস্তাফিজ ধূমকেতুই!

চোট, ছন্দহীনতা, তাঁর তূণের সবচেয়ে মারণাস্ত্র সেই কাটারের নির্বিষ হয়ে পড়া...ভয় তো জাগাচ্ছিলই। ভয়ের কুশায়ামাখা মেঘ কেটে সেই হাসির রোদ উঠেছে আবার।

এই সিরিজে মোস্তাফিজ যেন খুব উপভোগ করছেন নিজের বোলিং। আর মোস্তাফিজের বোলিং দেখে ফিরে আসছে সেই বোলিং দেখার আনন্দ। ক্রিকেট মানে যে শুধু চার-ছক্কার বিনোদন নয়; প্রতিটা ডেলিভারি দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে, সে কথা দুই বছর আগে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। দিচ্ছেন এই সিরিজের প্রতি ম্যাচ। তাঁকে রক্ষণাত্মক খেলতে গিয়েও ভারসাম্য হারাচ্ছেন ব্যাটসম্যানরা! মেরে খেলতে গিয়ে বলের লাইন মিস করছেন, বিট হচ্ছেন বারবার। কিংবা প্লেড অন!

আজ তো টানা তিন ওভার মেডেন দিয়ে শুরুই করলেন। মেডেনটা টানা চার ওভার হলো না শেষ বলে এক রান দিয়ে ফেলায়। ৪-৩-১-০! প্রথম স্পেলের পর দীর্ঘ বিরতি। প্রেসবক্স প্রান্ত বদলে ওপাশ থেকে ৩৩তম ওভারে তাঁকে ফিরিয়ে আনলেন মাশরাফি। প্রথম বলে এক ধাপ এগিয়ে মিডঅফের দিয়ে উড়িয়ে মারলেন সিকান্দার রাজা।

অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্সই হয়তো ভাবছেন রাজা সাহেব। পরের বলেও মেরে খেলতে চেয়েছেন, ব্যাটের ভেতরের কোনায় লেগে একটুর জন্য স্টাম্প মিস করল। স্টাম্পে লাগলে কী হতো, সেটা এক বল পরেই দেখা গেল। এবার প্লেড অন। তারপরের বলে ক্যাচ গেল প্রথম স্লিপে, পড়ল এনামুলের একটু সামনে। ১০ রান দেওয়া পঞ্চম ওভারটাই হয়ে থাকল সবচেয়ে ঘটনাবহুল। পরের ওভারেও ৫ বলে কোনো রান নেই। এরপর তো ইনিংসটা মুড়িয়েই দিলেন।

এই সিরিজটা নিঃসন্দেহে বলা যায় মোস্তাফিজের পুনর্জন্মের। যেখানে ঠিক উইকেট সংখ্যায় বিবেচনা করা যাবে না তাঁকে। মোস্তাফিজ যেন সেই আবার দুর্বোধ্য শব্দের অভিধান হয় উঠেছেন। মোস্তাফিজ যেন উত্তর-আধুনিক গদ্য কবিতা! বিমূর্ত কোনো চিত্রকলা! তাঁর প্রতিটা ডট বলেই ধরে থাকল সেই শিল্প।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ডট দিয়েছেন ৪১টি! পরের ম্যাচে ৫ ওভারের বেশি বোলিং পাননি শ্রীলঙ্কা আগেই বাক্সপেটরা গুছিয়ে ফেলেছিল বলে। তবু সেই ম্যাচেও ১৬টা ডট। আজ ৩৯ বলে ডট দিলেন ৩৩টি!

ত্রিদেশীয় সিরিজের অধ্যায়টিকে নতুন করে ধরলে মোস্তাফিজের ক্যারিয়ারকে তিনটা ভাগ করা যায়। আবির্ভাব পর্বে বিস্ময়কর উত্থানের গল্প লেখালেন ৯ ম্যাচে ২৬ উইকেট নিয়ে। গড় মোটে ১২.৩৪, স্ট্রাইক রেট ১৭-এর সামান্য ওপরে। ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেট। ইকোনমি ৪.২৬।

২০১৫-এর নভেম্বরের পর ১৩ মাস বিরতি দিয়ে ওয়ানডেতে ফিরলেন ২০১৬-এর ডিসেম্বরে। সেখান থেকে গত চ্যাম্পিয়ন ট্রফি পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সেই ভয়ের শিহরণ জাগানিয়া, হতাশায় মোড়ানো দ্বিতীয় অধ্যায়। এই সময়ে ১৩ ম্যাচে ১৮ উইকেটের পরিসংখ্যান হয়তো খুব একটা মন্দ নয়। কিন্তু গড় হলো দ্বিগুণের বেশি (৩০.৫৫)। ১৭ বলে একটি করে উইকেট পেতেন, সেখানে এই অধ্যায়ে প্রতি উইকেটের জন্য ৩৪ বলের অপেক্ষা। ৪ উইকেটই পেলেন মোটে একবার। ইকোনমি ছিল ৫.৬৬।

এই সিরিজের তিন ম্যাচে তাঁর ৫ উইকেট, গড় ১৩। ইকোনমি ৩.০২! পুরো সিরিজে ১২৯ বলের ৯০টিতেই দিয়েছেন ডট!

না, মোস্তাফিজ হারিয়ে যাননি। মোস্তাফিজ হারিয়ে যেতে পারেন না!

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন