পিএনএস ডেস্ক: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় এটি প্রস্তাবনা আকারে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন হলে অধিভুক্তি বাতিল চূড়ান্ত হবে। তবে তার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলমান ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, দুই উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সাত কলেজের অধ্যক্ষরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রাখাসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। শিগগির সিদ্ধান্তগুলো প্রকাশ করা হতে পারে।
গত ৬ জানুয়ারি ঢাবির অধিভুক্ত সাত কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে প্রথম বর্ষে ভর্তির অনলাইন আবেদন শুরু হয়। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ আবেদন প্রক্রিয়া চলার কথা ছিল। ভর্তি বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী— এবার সাত কলেজের পাঁচটি ইউনিটে আসন সংখ্যা ২৩ হাজার ৫৩৮টি। পাঁচটি ইউনিটে আবেদন নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে এসব আসনে শিক্ষার্থী নির্বাচিত করার কথা ছিল। তার আগে অধিভুক্তি বাতিলে এখন সব এলোমেলো।
সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের যে ঘোষণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিয়েছে, তা তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত। এটি চূড়ান্ত করতে অবশ্যই সিন্ডিকেট সভা করার প্রয়োজন। তবে সিন্ডিকেটে সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগেই চলমান স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে প্রথমবর্ষে ভর্তির আবেদন স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) থেকে কোনো ভর্তিচ্ছু আর আবেদন করতে পারবেন না।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ঢাবি কর্তৃপক্ষ এ ভর্তি প্রক্রিয়া আর চালাতে চায় না। সেই ঘোষণা তো দিয়েছেন তারা। আজ একটা মিটিং ছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আপাতত সাত কলেজের চলমান ভর্তি আবেদন বন্ধ থাকবে।’
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদও। তিনি বলেন, ‘বৈঠক ছিল। সেখানে ভর্তি বন্ধ রাখার একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটা কীভাবে, কখন থেকে বন্ধ হবে; তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হবে।’
সিন্ডিকেট সভায় অধিভুক্তি বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যেটুকু বলেছি, এর থেকে বেশি বলতে পারবো না। এটা নিয়ে এর বেশি কিছু বলাটা সমীচীনও হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে বিস্তারিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
শিক্ষার্থীরা চাইলে আবেদনের টাকা ফেরত
৬ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি— টানা ২৪ দিন সাত কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন নেওয়া হয়েছে। সাত কলেজের ভর্তি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, এরই মধ্যে প্রায় ৩৮ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। বিগত ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এক লাখের কিছু বেশি আবেদন জমা পড়েছিল। এবার তার চেয়েও বেশি আবেদন জমা পড়তো বলে ধারণা তাদের।
ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী— এবার সাত কলেজে বিজ্ঞান অনুষদে মোট আসন ৮ হাজার ৬২৭টি। এর মধ্যে কোটা ভর্তির সুযোগ পাবেন ৬১৮ জন। কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে আসন ১০ হাজার ১৯টি। তার মধ্যে কোটায় ভর্তি হতে পারবেন ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। তাছাড়া ব্যবসা শিক্ষা অনুষদে আসন ৪ হাজার ৮৯২, যার মধ্যে কোটায় আসন ৩৯০টি।
ভর্তি-সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছর সাত কলেজে ভর্তি আবেদন ফি ৮০০ টাকা। প্রায় ৬৮ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করায় এরই মধ্যে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ফি বাবদ পাঁচ কোটিরও বেশি টাকা আয় করেছে।
শিক্ষার্থীদের ভর্তি আবেদনের ডাটা ও ফি থেকে আয় হওয়া টাকা কীভাবে হস্তান্তর হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। বিষয়টি নিয়ে আজকের বৈঠকে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—অধিভুক্তি বাতিলে কেউ যদি সাত কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে বা ভর্তি হতে না চায়, তবে তাকে ফি’র টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া দুজন অধ্যক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাদের একজন বলেন, ‘বিষয়টা শুনতে খারাপ শোনালেও সত্য যে ঢাবির অধিভুক্ত…মানে সার্টিফিকেটে ঢাবির লোগো থাকে এজন্য অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজে ভর্তি না হয়ে সাত কলেজে আবেদন করে। অধিভুক্তি বাতিলে তারা যদি মনে করে, এখন আর তারা এখানে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায় না, তাহলে তাদের ফি’র টাকা ফেরত দেবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। এ সিদ্ধান্তটাও হয়েছে।’
আরেকজন অধ্যক্ষ বলেন, ‘বিষয়টি ঢাবি কর্তৃপক্ষই বৈঠকে তুলেছিল। তাদের ভাষ্য ছিল, অনেকে ঢাবির অধিভুক্ত জেনে সাত কলেজে আবেদন করেছে। তারা এখন যদি সরে যেতে চায়, তাহলে তাদের সেই সুযোগ দিতে হবে। তারা আবেদন করলে টাকা ফেরত পাবে।’
বিষয়টি নিয়ে ঢাবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান। তার ভাষ্য, ‘এমন অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষ জানাবে।’
সরকার চাইলে ভর্তি প্রক্রিয়া চালিয়ে নেবে ঢাবি
সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল নিয়ে সরকারের সঙ্গে ঢাবি কর্তৃপক্ষের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ঢাবি উপাচার্য অধিভুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিলেও তা সরকারকে কিছুই জানানো হয়নি বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন খোদ শিক্ষা উপদেষ্টা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে স্পষ্টই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ঢাবি প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ দূরত্ব ঘোচাতে কিছুটা ‘নমনীয় অবস্থানে’ ঢাবি।
উপাচার্যের সঙ্গ অধ্যক্ষদের আজকের বৈঠকে সেই বিষয়টি নিয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া দুজন অধ্যক্ষ এবং ঢাবির একজন কর্মকর্তা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে জানান, বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। এটা উপাচার্য নিজেই বৈঠকে তুলে ধরেছেন। তিনি এ জন্য একটি পথ খোলা রেখেছেন। সেই পথ হলো— সরকার যদি আহ্বান জানায় তাহলে ভর্তির আবেদনসহ ভর্তির কাজটি ঢাবি কর্তৃপক্ষ চালিয়ে নেবে।
এ প্রসঙ্গে বৈঠকে থাকা ঢাবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘হ্যাঁ, উপাচার্য স্যার বলেছেন যে এভাবে না করে অন্যভাবে করলে ভালো হতো। তবে পরিস্থিতির কারণে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনায় সরকার যদি বলে, তাহলে আমরা (ঢাবি) ভর্তির প্রক্রিয়াটা চালিয়ে নেবো। বিশেষ করে আবেদন প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত নেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।’
আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের ঘোষণার পর থেকে মহাসংকটে পড়েছে সরকার। মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) দিনভর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে একেক সময় একেক বক্তব্য দিয়ে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। কখনো বলেছেন ‘সরকারকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাবি’, কখনো বলেছেন, ‘সাত কলেজ নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সমাধানের পথ ভেবে পাচ্ছেন না’।
শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন দিশাহারা অবস্থা দেখে রাতে সভা ডাকেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে ঢাবির উপাচার্য ও ইউজিসি চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন অংশ নেন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। একটা পথ বের হবে হয়তো। তবে তা সহজ হবে না।’
বিষয়টি নিয়ে আজও বৈঠক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সাত কলেজ নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। সেখানেও কোনো পথ খোলেনি। সিদ্ধান্ত ছাড়াই পরবর্তী বৈঠকের তাগিদে শেষ হয়েছে সভা।
জানতে চাইলে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘কীভাবে কী হবে, তার কিছুই আমরা জানি না। কেউ আমাদের নিয়ে বসেননি। বিশেষজ্ঞ কমিটিতেও সব অধ্যক্ষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় হলে তো অধ্যক্ষই থাকবে না। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কীভাবে, কী করা হবে; তা নিয়েও আমাদের সহকর্মীরা শঙ্কিত।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা সরকারি কর্মচারী। সরকার যদি সুন্দরবনেও পোস্টিং দেয়, সেখানে গিয়ে কাজ করতে হবে। তবে জগন্নাথ কলেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল, তখন সেখানকার শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সাত কলেজের ক্ষেত্রে যেমন তেমনটি না ঘটে, সেটাই আমাদের চাওয়া।’
পিএনএস/রাশেদুল আলম
সাত কলেজে ভর্তি আবেদন বন্ধ, শিক্ষার্থীরা চাইলে ‘আবেদনের টাকা ফেরত’
30-01-2025 12:09AM