তুরস্ক ও বিশ্ব রাজনীতিতে এরদোগান

  27-10-2017 12:50PM


পিএনএস ডেস্ক: রাজনৈতিক ঘটনাবহুল ২০১৬ কে বিশ্লেষণ করলে বিশ্ব রাজনীতিতে যে নেতাদের নাম উঠে আসে স্বাভাবিকভাবেই তাদের শীর্ষে উঠে আসে তুরষ্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের নাম। ২০১৬ সালের নানা ঘটনা তাকে নায়ক থেকে মহানায়কে পরিণত করেছে। বর্তমান যুগের সুলতান সুলেমান নামটাকে তাই জনগণ তার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

একজন লেবু বিক্রেতা থেকে স্বীয় যোগ্যতায় তার প্রেসিডেন্ট বনে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছে বিশ^ বাসী। এরদোগান ২৮ আগস্ট ২০১৪ তে তুরষ্কের ১২ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকরেন। এর পূর্বে ১৪ মার্চ ২০০৩ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০১ সালে তিনি এ.কে পার্টির (জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার অল্প দিনেই দলটি জনসমর্থনের দিক দিয়ে এক নাম্বারে চলে আসে। দলটি ১৯৮৪ সালে প্রথমবার একক দল হিসেবে পরপর চারবার (২০০২, ২০০৭, ২০১১, ২০১৪) সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়। রাষ্ট্রপতি হবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ক্ষমতাসীন এই দলের সভাপতি ও প্রধান দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পূর্বে তিনি ১৯৯৪-১৯৯৮ পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তুরস্কে তার উল্লেখযোগ্য অবদান
ইইউ’র সাথে বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার চুক্তি তার অন্যতম সফলতা। নতুন ব্রিজ, বিমান বন্দরসহ বৃহৎ অবকাঠামো নির্মানের মাধ্যমে তলা বিহীন তুরস্ককে শক্তিশালী বাজারে পরিণত করেন তিনি। তার সরকার বিগত দশ বছরের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তুর্কি লিরার (তুর্কি মুদ্রা) মূল্য পুনঃনির্ধারণ করে তুরষ্কের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। এরদোগান অতীতের সেক্যুলার সরকার কর্তৃক আরোপিত হিজাবের উপর নিয়ন্ত্রন শিথিল করন, যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের হৃদয়ে দাগ কাটে। তিনি অতীতে অটোম্যান শাসনাধীন দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিশ্বায়নে নেতৃস্থানীয় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তিকে মূললক্ষ্য রেখে বৈদেশিক নীতি (নব তুর্কীবাদ) গ্রহন করেন। এছাড়া বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ফলপ্রসুভাবে নিয়ন্ত্রণের কারণে বিশ^মহলে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন।

২০১৬ সালের যে ঘটনা তাঁকে মহানায়কের পর্যায়ে নিয়ে আসে তা হলো ১৫ জুলাই ২০১৬ সংঘটিত সামরিক অভুত্থানের ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ঐ দিন ১১.০০ টায় অপরাহ্নে ইইএসটি (ইউটিসি+৩) আঙ্কারার উপর দিয়ে সামরিক জেট বিমান উড়তে দেখা যায় এবং ইস্তাম্বুলের ফাতিহ সুলতান মেহমেত এবং বসফরাস উভয় সেতুর আনাতোলিয়া এবং ইউরোপ দিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর একটি অংশ নিয়ে গঠিত ‘তুর্কি শান্তিপরিষদ’ নামক সংগঠন এই অভ্যুত্থান করার প্রচেষ্টা চালায়। তারা তুরষ্কের পার্লামেন্ট ও রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে বোমা হামলা করে। এরদোগান সপরিবারে মারমারি তে ছুটি কাটানোর জন্য অবস্থানরত থাকায় বেঁচে যান। টেলিভিশনে অভ্যুত্থানের নিউজ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে সংযোগ করে জনগণকে মাঠে নামার আহ্বান জানান। নেতার আহ্বানে অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। ইস্তাম্বুলে চলন্ত ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ে। জনগণের বাঁধার মুখে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। শুরু থেকেই অভ্যুত্থানের জন্য এ.কে পার্টির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লা গুলেনকে দায়ী করা হয়। যদিও ফেতুল্লা গুলেন তা অস্বীকার করেন।অভ্যুত্থান ষড়যন্তের অভিযোগে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৬০০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এই অভ্যুত্থানের সমালোচনা করা হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোন নেতার বিরুদ্ধে এমন অভ্যুত্থান লজ্জাজনক বলে বিবৃতি দেন আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ। অভ্যুত্থানকারীদের জন্য মৃত্যুদন্ড কার্যকরের জন্য তিনি সংবিধান সংশোধনের চেষ্টাকরেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্ষেত্রে তাদের সদস্যপদ না দেওয়ার ইংগিত দেন। উল্লেখ্য, তুরস্ক ইইউ-র সদস্যপদ পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তন এনেও সদস্যপদ পেতে ব্যর্থ হয়। বিশ্ব রাজনীতিতে তুরষ্কের আরও একটি নাটকীয় পরিবর্তন হল রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক গঠন। ২৪ নভেম্বর ২০১৫-তে তুরষ্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভুপাতিত হবার পর দু’দেশের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়। এতে দু’দেশের রেষারেষি চরম রূপ ধারণ করে। এরদোগান রাশিয়ার সমালোচনা করে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানিয়ে দেন। তবে তিনি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে আগ্রহী নন এবং সরাসরি আলোচনায় এ নিয়ে সমঝোতায় আসতে চান বলে বিবৃতি দেন। অবশেষে পুতিন ও এরদোগান বৈঠকে দু’দেশের সমঝোতায় সম্পর্কের যে উন্নতিহয়, তাতে পশ্চিমা নেতাদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরদোগান স্পষ্ট জানিয়ে দেন তুরস্ক কার সাথে সম্পর্ক করবে নাকি করবেনা তা নিয়ে অন্যদের মাথা ব্যাথার কারণ নেই। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য দেশটির কুটনৈতিক পর্যায়ে কোন প্রভাব ফেলবেনা বলে জানান।

বিশ্ব রাজনীতিতে এরদোগানের অবদান এক কথায় অনস্বীকার্য। সিরিয়ার চলমান সংকট নিয়ে রাশিয়া, সিরিয়া, তুরস্ক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে এরদোগান বিশেষ অবদান রাখেন। সংকট নিরসনে রাশিয়ার সাথে সম্মিলিত উদ্যোগ এবং সিরিয়ার উদ্বাস্তদের জন্য সীমান্তখুলে দেওয়ার কথাও জানান তিনি। এছাড়া প্রেসিডেন্ট এরদোগান আই এস দমনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছেন। ইতিমধ্যে ইরাকে তুর্কী সেনাবাহিনীও প্রেরণ করেন তিনি। তিনি বলেন আইএস জিহাদের নামে মুসলমানদের চরম ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে।

মুসলিম বিশ্ব ঐক্যের ডাকঃ তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে দু’দিনব্যাপী (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের ডাক দেন এরদোগান। এ সম্মেলনের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার বিদ্যমান তিক্ততা দূর করে সুসম্পর্কের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানান তিনি। তার বক্তব্য ছিল- আমাদের ধর্ম ইসলাম, শিয়া বা সুন্নি নয়।

রোহিঙ্গা ইস্যুঃ মায়ানমারের নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশে সর্বদাই সুদৃঢ় অবস্থান এরদোগানের। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর মানবতাবিরোধী জঘন্য নির্যাতনের কঠোর সমালেচনা করেন তিনি। এছাড়া তিনিই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানান।

কাশ্মির সমস্যাঃ পাকিস্তান সফরে এসে কাশ্মির নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এরদোগান। ভারত-পাকিস্তানকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতেও পরামর্শ দেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট এরদোগানের শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে তুরস্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এছাড়া মুসলিম দেশগুলোর নিকট তুরস্ক পরিণত হয়েছে রোল মডেলে। আগামী দিগুলোতে এরদোগানের এই বলিষ্ঠ ভূমিকা মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও ঐক্য প্রক্রিয়াকে যে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে তার আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
-মুহাম্মদ বদিউল আলম

পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন