পিএনএস ডেস্ক: এক সময় বলা হতো জয়নাল হাজারীই ফেনীর সব। জেলায় তার কথাই ছিল শেষ কথা। অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন, সন্ত্রাস, মাদক সবই চলতো তার ইশারায়। যার দাপটে কাঁপতো ফেনী। ২০০১ সালে যৌথ বাহিনীর এক অভিযানে দেশ থেকে পালিয়ে যান জয়নাল হাজারী। শেষ হয় তার অধ্যায়। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ত্রাসের রাজত্বে নতুন রাজা হয়ে আসেন তারই এক সময়ের শিষ্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে ফেনী-২ আসনের এমপি হওয়ার আগ থেকেই পুরো জেলার একক নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন তিনি। জেলায় তিনিই অঘোষিত রাজা। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, সন্ত্রাস, অবৈধ অস্ত্র মাদক চোরাচালান সবই হতো তার নিয়ন্ত্রণে।
গত ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালানোর পর থেকে লাপাত্তা তিনি। কেউ বলছেন দেশে আছেন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজাম হাজারী ভারতে পালিয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশ পুরনো হলেও ফেনীতে আধিপত্য বিস্তারের গল্প বেশি দিনের নয় এই সাবেক এমপি’র। ২০১৪ সালের বিতর্কিত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নামের পাশে এমপি’র তকমা লাগে নিজাম হাজারীর। তখন থেকেই ফেনীর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে চলে যায়। একক আধিপত্যে ফেনী শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে নিজাম হাজারীর নামে চাঁদা ওঠে না। মহিপাল বাসটার্মিনাল, ফেনী শহরের ব্যবসায়ী, ফুটপাথের দোকানি সব জায়গার চাঁদা উঠতো নিজাম হাজারীর নিয়ন্ত্রণে। আর এসব চাঁদা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের নেতারা।
বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফেনীতে নিজাম হাজারী শুধু বিরোধী দলকেই দমন করেননি দমন করেছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদেরও। তার দাপটে কোণঠাসা ছিলেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেলায় অঘোষিতভাবে অবাঞ্ছিত করে রাখেন সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীকে। এক সময়ে জয়নাল হাজারীরই স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন নিজাম হাজারী। আত্মীয়তার সম্পর্কও রয়েছে তাদের। এমনকি নিজের গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন নিজাম হাজারীর জীবদ্দশায় এমন দাবিও করেছিলেন জয়নাল হাজারী। জেলায় নিজাম হাজারীর অপকর্মের সহযোগী হিসেবে পরিচিত পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, সদর উপজেলার চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন, ছাগলনাইয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাহ উল হায়দার চৌধুরী সোহেল, ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন মজুমদারসহ আরও অনেকে।
অভিযোগ রয়েছে, ফেনীর একাধিক বালুমহাল থেকে দেড় দুই কোটি টাকা চাঁদা আদায় হতো। এ ছাড়া রাজাঝি দীঘিরপাড়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে চাঁদার একটা অংশ উঠতো। এখানে ৪শ’র অধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকানের প্রতিটি থেকে অন্তত ৩শ’ টাকা করে প্রতিদিন আদায় হতো। যার পুরো অংশটাই চলে যেতো নিজাম হাজারীর ব্যক্তিগত কোষাগারে।
সূত্রমতে, ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পর থেকেই তার অনুসারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন চাঁদাবাজিতে। দিন প্রতি তিনশ’ করে মাসে অর্ধ কোটির উপর চাঁদা শুধু রাজাঝি দীঘিপাড়েরভ্রাম্যমাণ দোকানিদের কাছ থেকেই উঠতো। চাঁদা না দিলেই উঠিয়ে দেয়া হতো। বৃহস্পতিবার সরজমিন দেখা যায়, দোকানিরা বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে ব্যবসা করছেন। চোখে মুখে কোনো ভয়ের চিহ্নও নেই।
শাওন নামের এক দোকানি বলেন, ক’দিন আগেও ৩০০ করে দেয়া লাগতো। ৫ তারিখের পর আর কেউ আসে নাই। কাকে চাঁদা দিতেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একেক সময় একেকজন নিতো। সবাই এমপি সায়েবের (নিজাম হাজারী) লোক বলতো। রাজাঝি দীঘির উত্তর পাড়েও বেশকিছু ভ্রাম্যমাণ দোকানি ব্যবসা করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, নিজাম হাজারীর নামে সেখান থেকে মনির নামে এক ব্যক্তি চাঁদা ওঠান। প্রতি মাসে একেক দোকান থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার পর্যন্ত আদায় করেন। এ ছাড়া কলেজ রোড এলাকায় ছাগলনাইয়াগামী অন্তত একশ’ সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা করে ওঠানো হয়। যতবার সিরিয়াল ততবার ১০ টাকা। সেখানে এই টাকা তোলার দায়িত্ব পালন করেন করিম নামের এক ব্যক্তি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি বলেন, দোকানদারদের কাছ থেকে ৫ই আগস্টের পর থেকে কেউ টাকা নিতে আসেনি। তবে এখন থেকে আর দিবো না। শাওন নামের এক সিএনজিচালক বলেন, ১০ টাকা করে দিতে হয় এখনো। সে রাজনীতি করে না। তবে লীগের নেতাদের সঙ্গে চলে।
অন্যদিকে ফেনী শহীদ মিনার ও দীঘির পাড়ের সব দোকান থেকে চাঁদা তুলতেন জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জালাল হাজারীর লোকজন। জালাল নিজাম হাজারীর আত্মীয়।
ফেনী ট্রাঙ্ক রোড, মিজান রোড, কলেজ রোড, মাস্টারপাড়া, ডাক্তারপাড়া, স্টেশন রোড, হাসপাতাল রোডসহ বিভিন্ন সড়কে অন্তত ৪ হাজার ফুটপাথ দোকানি রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় হতো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনী শহরে এসব চাঁদার নিয়ন্ত্রক ছিলেন পারভেজ হাজারী। তিনি ফেনী শহরের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। নিজাম হাজারীর ঝেঠাতো ভাই।
চাঁদার আরও যতো খাত: নিজাম হাজারীর লোকজন প্রতিদিন ফেনী থেকে তিন কোটি টাকার বেশি চাঁদা তুলতো। এর সিংহভাগ আসতো জেলার একাধিক বালুমহাল থেকে। বালু ছাড়াও পরিবহন, সরকারি সকল দপ্তরের টেন্ডার, ছোট-বড় সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উঠতো চাঁদা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশের টার্মিনাল থেকে মাসে কোটি টাকার চাঁদা উঠাতো মেয়র স্বপন মিয়াজীর অনুসারী পৌর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সুমন। মহাসড়কে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান থেকে মোটা অংকের টাকা তুলতো ভূঞা ট্রান্সপোর্টের স্বত্বাধিকারী শ্রমিকনেতা মোহাম্মদ আলী। ফেনীর দক্ষিণাঞ্চল থেকে পরিবহনে লাখ টাকার চাঁদা তুলতো শ্রমিক লীগ নেতা হানিফ-মানিক।
সদর হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতেন শর্শদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা জানে আলম। পৌর কাউন্সিলর কহিনুর আলম রানা, আবুল কালাম (গরু কালাম), শিপন, শরিফ তার বাহিনীর হাতিয়ার ছিল। অন্যদিকে সরকারি দপ্তরের সব ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রক ছিলেন শুসেন চন্দ্র শীল। তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। ফেনী শহরে শুসেনকে সবাই নিজাম হাজারীর ক্যাশিয়ারও বলে থাকেন।
অস্ত্রের চোরাচালান যেভাবে নিয়ন্ত্রণ হত: ফেনী জেলার ছয়-উপজেলার মধ্যে চার উপজেলায় সীমান্ত থাকায় এসব সীমান্ত দিয়ে মাদক, চোরাচালান ও অস্ত্র ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন মজুমদার, ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাহ্ উল হায়দার চৌধুরী সোহেল, পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরশুরাম পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেল সহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
নিজাম হাজারীর অপকর্মের বিষয়ে জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নিজাম হাজারী রাজনীতি করতেন না। তিনি চাঁদাবাজি, অস্ত্র চোরাচালান সহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কখনো আলাউদ্দিন নাসিম, কখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সমর্থন নিয়ে ফেনী শহরে রাজত্ব কায়েম করে গেছেন। তিনি আরও বলেন, নিজাম হাজারীর প্রধান ডান হাত ছিল পৌরসভা মেয়র স্বপন মিয়াজী। তার সঙ্গে সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠতা। গত কয়েক বছরে ওবায়দুল কাদেরকে নানারকম সুবিধা দিয়ে নিজের অবস্থান পাকা করেছেন নিজাম হাজারী। ওবায়দুল কাদের কখনো নোয়াখালীতে যেতেন না। ঢাকা থেকে এলেই ফেনীতে থাকতেন। এখানে কুসুমবাগে একটি জঙ্গলবাড়ী আছে। সেখানে ওবায়দুল কাদেরকে নারী সুবিধা দিতেন নিজাম হাজারী ও স্বপন মিয়াজীরা। মূলত এসব করেই ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছেন নিজাম হাজারী। আমরা যারা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ করি তাদের বিরুদ্ধে এক ডজন করে মামলা করে এলাকাছাড়া করেছেন।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, নিজাম হাজারী ফেনী শহর না পুরো জেলাকে একক নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন আর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গত ১৫ বছর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
একইভাবে বললেন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ শাহাদাত হোসেনও। তিনি বলেন, ভোটারবিহীন সরকারের এমপি নিজাম হাজারী। ফেনীতে চাঁদাবাজি, মাদক এমন কোনো অপরাধ নেই তিনি করেননি। শহরে তিনিই ছিলেন একক নিয়ন্ত্রক।
জিরো থেকে নিয়ন্ত্রক নিজাম হাজারী: অনেকটা জিরো থেকে নিয়ন্ত্রক হয়েছেন ফেনীর আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম উদ্দিন হাজারী। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ফেনীতে তেমন কেউ চিনতো না নিজাম হাজারীকে। তার শৈশব ও যৌবন কাল কেটেছে চট্টগ্রামে। তিনি তৎকালীন সময়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থাকলেও চট্টগ্রামের শিবির তার নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত সরকারের শাসনামলে তিনি চট্টগ্রামে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল বলেও জানা যায়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছিরের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন নিজাম হাজারী।
২০০১ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে তৎকালীন সংসদ সদস্য গডফাদার খ্যাত জয়নাল আবেদীন হাজারী পালিয়ে দেশান্তরী হলে কার্যত ফেনী আওয়ামী লীগ শূন্য হয়ে যায়। জয়নাল হাজারীর অনুসারী ছিলেন একরামুল হক একরাম।
২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে জয়নাল হাজারী পরবর্তী ফেনীর আওয়ামী রাজনীতির হাল ধরতে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী আসেন নিজাম হাজারী। তৎকালীন যুবলীগ নেতা জয়নাল হাজারীর ঘনিষ্ঠজন একরামুল হক একরামের পরামর্শে নিজাম হাজারী চট্টগ্রাম থেকে ফেনীতে আসেন। প্রথমে দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেন।
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও ফেনীর তিনটি আসন ছিল বিএনপি’র কাছে। বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফেনীতে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হতে ২০০৯ সালে দলের জেলা সম্মেলনে নিজাম উদ্দিন হাজারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগে একরামের অনুসারীরা জানান, ফেনীর একসময়ের সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারীকে স্থানীয় রাজনীতি থেকে তাড়ানোর ক্ষেত্রে নিজাম হাজারীর বড় সহযোগী শক্তি ছিল একরাম ও তার বাহিনী। একজনের বিপদে আরেকজন ছুটে যেতেন। একরাম ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আর নিজাম হাজারী ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০০৮ সালে নিজামের ঘনিষ্ঠজন হলেও বছরখানেক পর থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নানা বিষয়ে একরামের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল। একরাম অর্থ ও পেশিশক্তিতে নিজাম হাজারীর প্রায় সমকক্ষ ছিলেন। ফেনীর ঠিকাদারি ব্যবসার বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন একরাম। টেন্ডার বাণিজ্য, ফেনীর ডায়াবেটিক হাসপাতালের আধিপত্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কমিটি ঘোষণা নিয়ে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম হাজারীর সঙ্গে একরামের বিরোধ শুরু হয়। ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডিসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন একরাম চেয়ারম্যান। এ নিয়ে দু-তিন দফা নিজাম হাজারীর বাহিনীকে আটকে রাখে একরামের দলবল। ডায়াবেটিক হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ ছিল একরামের কাছে। ২০১৩ সালে আধিপত্য নিতে যায় নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ ও তার ‘বুদ্ধিদাতা’ হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীর কবির আদেল ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশীদ। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন একরাম। পরবর্তী ২০০৮ থেকে পরের পাঁচ বছরে একরামকে অন্ধকারে রেখে ফেনীতে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজাম হাজারী। তখন নিজাম হাজারী ফেনীর রাজনীতিতে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন একরামকে।
চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় ২০০০ সালের ১৬ই আগস্ট অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় ১০ বছর এবং ১৯(চ) ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় নিজাম হাজারীর। দুই বছর ১০ মাস কম সাজা খেটেই কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ফেনী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। কারাগার কর্তৃপক্ষ এটিকে জালিয়াতি বলে মন্তব্য করেছিল। বিষয়টি জনসম্মুখে আসার ঘটনাতে একরাম জড়িত ছিল মনে করেন নিজাম হাজারী।
তাদের দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৪ সালে ‘নিজাম হাজারীর পরিকল্পনায়’ নৃশংসভাবে খুন হন ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরাম। গুলি করার পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা- এ বর্বরতা মেনে নিতে পারেনি দলীয় নেতাকর্মীরা। একাধিক সূত্রের দাবি, চাপের মুখে বিএনপি’র নেতাকে আসামি করে মামলা করতে বাধ্য হয় নিহতের ভাই রেজাউল হক জসিম। নির্মম হত্যার জন্য ফেনী সদর আসনের এমপি নিজাম হাজারীকে দায়ী করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী।
একরামকে খুনের পর যুবলীগ নেতা আরজু, সাজু ও শাখাওয়াত ছাড়া দলের অন্য সব নেতারা নিজাম হাজারীকে নিয়ে কথা বলতে সাহস পেত না।
নিজাম হাজারীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সব সরকারি দপ্তর ছিল কার্যত জিম্মি। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত জেলার সব ধরনের সংস্থা (চেম্বার, ব্যবসায়ী সমিতি, ক্রীড়া সমিতি, ডায়াবেটিক সমিতি, হার্ট ফাউন্ডেশন) ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কোনো সরকারি দপ্তরের কাজ কে করবে কোথায় কতো অর্থ সংগ্রহ হবে সবই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বিগত সময়গুলোত অবৈধ পথে উপর্জিত অর্থে প্রায় ‘দেড় হাজার কোটি’ টাকা ব্যয়ে মাস্টারপাড়ায় বাংলো বাড়ি, একাধিক সুউচ্চ অট্টালিকা গড়েছেন। সম্পদের পাহাড়ে করেছেন সিগ্ধা ওভারসিস, মালয়েশিয়ায় ম্যানপাওয়ার ব্যবসা ও একাধিক জাহাজের স্বত্বাধিকারী। নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামা অনুযায়ী বিগত ১০ বছরে ‘টাকা ও সম্পদের পাহাড়’ গড়েন ফেনী-২ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। ২০১৩ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার সম্পদ বিবরণী থেকে এমন তথ্যে উঠে এসেছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে তৎকালীন সময়ে ফেনী পৌর মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। মেয়র ছেড়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ফেনী-২ আসনের এমপি হতে পূরণকৃত হলফনামায় নিজাম উদ্দিন হাজারী ও তার স্ত্রী নুরজাহান বেগমের সম্পদ দেখিয়েছিলেন ৪ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৬৮ টাকা।
নিজাম হাজারী এমপি হওয়ার পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৭ হাজার ২০২ টাকায়। আর গত পাঁচ বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৪ কোটি ৬২ লাখ ৭৬ হাজার ২৪৩ টাকায়। গত ১০ বছরে তাদের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। আর্থিক অঙ্কে যা ১২০ কোটি ৪৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৫ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করা হলফনামাসহ বিগত তিন হলফনামা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য উঠে আসে।
পিএনএস/আনোয়ার
ক্লাস কমিটির মেম্বার থেকে ফেনীর কিং
16-08-2024 10:03AM