পিএনএস ডেস্ক: গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা ঘোষণায় একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ ছিল। এরপর সেপ্টেম্বরে দেশ পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়।
ডিসেম্বর জানা যায়, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন দল গঠন করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসে। ফলে এক দফার ঘোষক নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে ২৮ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ছাত্র-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি যখন নতুন দল গঠনের পরিকল্পনা করে, তখন ছাত্র রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তনের জন্য নতুন দলের জন্য একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের দুইদিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও জাহিদ আহসানের নেতৃত্বে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।
সংগঠনটিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির ছাত্র শাখা হিসেবে দেখা হলেও নতুন এ ছাত্র সংগঠনটি কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, আক্ষেপ, ভবিষ্যৎ নিয়ে জানার চেষ্টা করে রাইজিংবিডি ডটকম।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণে একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত, ১৬-১৭টা দল আত্মপ্রকাশ করলেও এটা কিছুটা ব্যতিক্রম।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দ বারবার নিজেদের ‘ভারতপন্থি’ ও ‘পাকিস্তানপন্থি’ বিরোধী এবং ‘বাংলাদেশপন্থি’ দল হিসেবে দাবি করেছেন। কিন্তু ‘আমেরিকাপন্থি’ বিরোধী মনোভাবের কথা বা ঘোষণা তাদের থেকে শোনা যায়নি। এ অস্পষ্টতা আমেরিকা, সিআইএ বা এই পন্থিদের লজিস্টিক নিয়ে দল তৈরি হয়েছে বলে জনমনে চাউর রয়েছে এবং তা সত্য বলেই পরিগণিত করছে।
এ দেশের মানুষ যতটা ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী, ততটাই মার্কিন আধিপত্যবাদবিরোধী। সুক্ষ্ম অস্পষ্টতার মাধ্যমে জনমানসের সঙ্গে করা প্রতারণার মুখোশ খসে পড়লে দলটি জনদাবি হারাবে। মানুষের একটা অংশের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া উদ্দীপনা নিমিষেই উবে গিয়ে ঘৃণার উদ্রেকও ঘটাতে পারে। কমিটিতে প্রদর্শিত এলজিবিটিকিউ নিয়ে সফটনেসের কারণে ইতিমধ্যে এর কিছুটা খসেও পড়েছে।
দলটির কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের নামে বিভিন্ন দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজির যে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাতে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব বেশি আশান্বিত হতে পারছি না। দেশ-জাতির কোনো কল্যাণ আদৌ বয়ে আনতে পারবে কি না, আমি তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
(লেখক: মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ, বাংলা বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ)
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হবে
নতুন ছাত্র সংগঠন গনতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, তারা যেন ২ সহস্রাধিক শহীদ ও প্রায় অর্ধলক্ষ আহতের বিনিময়ে অর্জিত ২৪ এর অভ্যুত্থানকে ধারণ করেন এবং শহীদদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নে ছাত্রদের মাঝে কাজ করেন। পাশাপাশি ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, নির্বিশেষে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সত্য ও ঐক্যের উপর অটল থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ছাত্রদের মাঝে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদকে একটি রোল মডেল করে গড়ে তুলতে পারে।
কিন্তু তাদের এ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি স্পষ্ট করতে হবে। যা তারা এখনো করতে পারেনি। আশা করি খুব দ্রুতই তারা করতে পারবে।
(লেখক: মো. শোয়াইব, স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ)
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি করতে হবে
ক্যাম্পাসে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে এমন সংগঠন নেই বললেই চলে। যেহেতু এই নতুন ছাত্র সংগঠনটি ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে গঠিত, সেহেতু তাদের রাজনীতি করতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদেরকে নিয়েও তাদের এজেন্ডা থাকতে হবে।
তাদের ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিতে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিতান্তই কম। ডাকসু নির্বাচনে তারা যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাহলে শীর্ষ পদে নারীরা আসবে কিনা সেটা নিয়েও আমি সন্দিহান। আর যদি আসেও, সেখানেও নারীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কমই থাকবে বলে আমার মনে হয়।
এই সংগঠনটি যেহেতু ক্যাম্পাসে পুরাতন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে ফেলার জন্য গঠিত হয়েছে, সেহেতু তারা আসলে কি করতে চায়, তার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করা উচিত। তাদের যথেষ্ট সময় দেওয়া দরকার বলে মনে হয়।
(লেখক: সামিয়া রহমান, পদার্থ বিজ্ঞান, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ)
সংগঠনে যেন সবার অংশগ্রহণ থাকে
জুলাই অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন যে ছাত্র সংগঠন গঠন করেছে, তা ছাত্র রাজনীতির জন্য ইতিবাচক। তবে এ সংগঠনে যেন জুলাই অভ্যূত্থানে অংশগ্রহণকারী সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকা উচিত।
পাশাপাশি এ সংগঠন যেন লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি থেকে বিরত থাকে এবং শিক্ষার্থী ওরিয়েন্টেড একটা প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠে। আমি চাই, এ দলটি প্রকৃত ইনক্লুসিভ রাজনীতি করুক এবং ক্যাম্পাসগুলোতে ক্রিয়াশীল অন্য সব ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করুক।
(লেখক: মোহাম্মদ রায়হান, ইংরেজি বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ)
তৃণমূল পর্যায়ে দলটির যোগ্য নেতৃত্ব নেই
জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রকাশ করেছে। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। এই নতুন দলের কাছে বাংলাদেশের নাগরিক ও ছাত্র সমাজের অনেক চাওয়া পাওয়া। এজন্য তাদের দায়বদ্ধতাও অনেক।
কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি তৃণমূল পর্যায়ে দলটির যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। অতিদ্রুত যদি দলটির তৃণমূল পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ না ঘটানো যায়, তাহলে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য দলের কাছে তারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে। আবার বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যারা নেতৃত্বে এসেছেন, তাদের কাছে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল ডাকসুসহ অন্যান্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সোচ্চার থাকবেন। কিন্তু অদৃশ্য কোন কারণে তারা ডাকসুর ব্যাপারে কোন কথাই আর বলছে না। এটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাচ্ছে।
তরুণ এই নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভালোবাসার পাত্র হয়েছে তাদের কর্মগুণের কারণে। পক্ষান্তরে এই তরুণ নেতারা যদি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোরাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। কারণ তাদের চেয়ে অনেক বড় বড় রাঘব-বোয়াল দুর্নীতিবাজ এদেশে রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারবে না। তাদেরকে তাদের অর্জিত পথের আদর্শকে ভুলে গেলে চলবে না।
(মামুন অর রশিদ, আরবি বিভাগ, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ)
গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়
নব গঠিত এই রাজনৈতিক দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাগপাশ থেকে এ দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই হিসেবে এ দলটি কৃতিত্বের দাবিদার বলে আমি মনে করি। তবে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য তাদের আরো চৌকষ হওয়া উচিৎ।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আশা করেছিল। কিন্তু ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির’ ছাত্র সংগঠনের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তাতে তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা এখনো কোন ধরনের ঘোষণা সামনে আনতে পারেনি। অথচ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আশা ছিল, কমিটি ঘোষণার দিনই তারা এটা সামনে আনবেন। তাদের গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংবলিত কোন তথ্য আমরা এখনো দেখতে পায়নি।
৭১ পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক দল এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারা কেউই এ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। আমরা আশা করি আগামীর বাংলাদেশে আরো দক্ষতার সঙ্গে তারা এ দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে।
পিএনএস/রাশেদুল আলম
নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ভাবনা
06-03-2025 12:10AM
