পিএনএস ডেস্ক: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে সাত মাস পার করেছেন। এই সময়ে তিনি চারটি বহুপক্ষীয় সফর করেছেন। তবে এখনো দ্বিপক্ষীয় কোনো সফর করেননি ড. ইউনূস। আশা করা হচ্ছে, চলতি মাসে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর শুরু করবেন তিনি। আর সেটি হতে পারে চীনে।
ঢাকা-বেইজিংয়ের নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্রগুলো এসব ইঙ্গিত দিয়েছে।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, চলতি মাসের শেষের দিকে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সফরে ড. ইউনূসের বেইজিং সফরের কথাবার্তা চলছে। প্রধান উপদেষ্টার আগামী ২৭ থেকে ২৮ মার্চ চীন সফর করার সম্ভাবনা রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিংয়ের পাশাপাশি বাও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা।
বেইজিংয়ের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, আগামী ২৫ থেকে ২৮ মার্চ চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হাইনানে চলবে বিএফএ সম্মেলন। সম্মেলনে যোগ দিতে ইতোমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে উভয়পক্ষের চাওয়া— ড. ইউনূসের বহুপক্ষীয় সফরের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সফর হোক বেইজিংয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনে থাকতে হয় সরকারপ্রধানকে। সেজন্য প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর না করার পক্ষে ছিল ঢাকা। কিন্তু বেইজিং ড. ইউনূসকে নিতে মরিয়া। তবে চীনের দিক থেকে শুধুমাত্র দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের প্রস্তাব ছিল। এক্ষেত্রে ঢাকা পাল্টা প্রস্তাবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক চায়। আর এটি নিশ্চিত হলে প্রধান উপদেষ্টার সফরের সম্মতির কথা জানানো হয়। কিন্তু ওই সময়ে শি’র ব্যস্ততা থাকবে তুঙ্গে, যার জন্য বেইজিং কিছুটা বিপাকে পড়ে। তবে ঢাকার স্পষ্ট বার্তা— প্রেসিডেন্ট শি’র সঙ্গে বৈঠক পেলে প্রধান উপদেষ্টার সফর হবে।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের ওপর পড়ে গুরুদায়িত্ব। পেশাদার কূটনীতিক ওয়েন শেষ অবদি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার প্রেসিডেন্টের বৈঠকের শিডিউল ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করে এ বার্তা দিয়ে গেছেন রাষ্ট্রদূত। এখন প্রধান উপদেষ্টার সবুজ সংকেত পেলে সফর নিশ্চিত। এক্ষেত্রে আগামী ২৬ মার্চ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান শেষে চীনের উদ্দেশ্যে রওনা করতে পারেন ড. ইউনূস।
স্থানীয় এক কূটনীতিক জানান, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেটি এখনো নিশ্চিত হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা রাজি হলেই সফর হবে। সফরটি এক সপ্তাহের নোটিশে হলেও সম্ভব হবে। কারণ, কিছু দিন আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা চীন সফর করেছেন, যার জন্য কাজ অনেকটাই এগিয়ে আছে।
সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের অতি আগ্রহের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টা এখনো কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সফর করেননি। চীন সফর হলে খারাপ হবে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু রাজনৈতিক সরকার নয়। সেজন্য চীনের যত আগ্রহ থাকুক না কেন, সিদ্ধান্ত বা প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে বুঝেশুনে নিতে হবে। এ ছাড়া, ভারতকে মাথায় রাখতে হবে, অন্যদিকে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র আমন্ত্রণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চীন সফর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেটি ছিল তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। ওই সফরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও তার সফর সঙ্গীদের বেশ আতিথেয়তা করেছিল বেইজিং।
সূত্রে জানা গেছে, সফরজুড়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের বিরল সম্মান করেছে বেইজিং। প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর বেইজিংয়ে হলে শি’র সরকার যে আন্তরিকতার কমতি রাখবে না, সেটি অনুমান করাই যায়। এক্ষেত্রে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর দিল্লি নাকি চীন হবে, সেটি নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কম প্রতিযোগিতা হয়নি। আর ওই বিতর্কিত নির্বাচনে দিল্লি-বেইজিংয়ের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল শেখ হাসিনা।
দিল্লি-বেইজিংয়ের প্রতিযোগিতা আর আলোচনার মধ্যে বিগত সরকারপ্রধান কৌশলে গত বছরের (২০২৪) এপ্রিলে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর করেন থাইল্যান্ডে। সফরটি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ছিল। এরপর জুনে দিল্লি সফর করেন শেখ হাসিনা। দিল্লি সফরের কিছুদিন পরে জুলাইয়ে বেইজিং সফর করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ওই সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। কেননা, একদিন আগে সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। আর ওই সময়ে কোটা সংস্কার নিয়ে দেশে আন্দোলন চলছিল। শেখ হাসিনা বেইজিং থেকে দেশে ফেরার মাস না পেরোতে ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হন।
চীনের জিডিআইয়ে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ?
বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর দিল্লি না চীন হবে, সেসময় সেটি নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা দেখা গেছে / ফাইল ছবি
শেখ হাসিনার পতনের তিন দিনের মাথায় গত বছরের ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন। এরপর নভেম্বরে আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। গত ডিসেম্বরে ড. ইউনূস ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে মিসর সফর করেন।
সবশেষ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (উব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রথম সফর বেইজিংয়ে হলে শেখ হাসিনাকে দিল্লির আগে সফর না করাতে পারার আক্ষেপ হয়তো ঘুচবে চীনের। আর এটি হয়তো কূটনৈতিক প্রতিশোধ হবে বেইজিংয়ের।
পিএনএস/রাশেদুল আলম
প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিং যাচ্ছেন ড. ইউনূস?
06-03-2025 12:02AM
