ক্ষমতার দাপটে ব্যবসায়ীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন লতিফ

  07-09-2024 01:29PM



পিএনএস ডেস্ক : ব্যবসায়ী থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ১৯ দিন আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন বন্দর-পতেঙ্গা আসনের (চট্টগ্রাম-১১) নৌকার টিকিট পাওয়া এমএ লতিফ। সেই নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে কখনো বিনা ভোটে, আবার কখনো কেন্দ্র দখল করে নৌকার টিকিটে জিতে যান তিনি। এ নিয়ে খোদ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও ছিল অসন্তোষ। তবে তার মাথার উপর কেন্দ্রের অদৃশ্য ছায়া থাকায় কোনো কিছুই তাকে ঘায়েল করতে পারেনি। ফলে প্রায় ১৫ বছরে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে তার দাপট।

এই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিসহ ব্যবসায় সংগঠনের সব জায়গায় ছিল তার একক আধিপত্য। সবশেষ গত বছর প্রভাব খাটিয়ে দরপত্র ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসের (শিপ হ্যান্ডলিং) লাইসেন্স নেন সাবেক এমপি লতিফ। নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে চট্টগ্রামের শতবর্ষী ব্যবসায় সংগঠনে কায়েম করেন ‘পরিবারতন্ত্র’। দেশের বৃহত্তম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল চট্টগ্রাম ইপিজেডেও ছিল তার প্রভাব। মূলত এমপি হওয়ার দাপটে ১৫ বছর ব্যবসায়ীদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন লতিফ।
হয়ে ওঠেন বেপরোয়া : এমএ লতিফ সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। এলাকার সাধারণ মানুষ তার ধারেকাছে ঘেঁষার সাহস পাননি। কথায় কথায় মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন লতিফ। পুলিশসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছ থেকে অপমানিত হয়েছেন। রাজনৈতিক কোনো নেতাকর্মীর কদরও ছিল না তার কাছে। ২০০৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। এরপর পতেঙ্গায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত এবং বিমানের ফ্লাইটে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেছিলেন তিনি। ক্ষমতার দাপটে দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন এমপি লতিফ।

অঢেল সম্পদ অর্জন : চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লতিফের বিপুল পরিমাণ জায়গা-জমি রয়েছে। ভুক্তভোগী ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ, ২০১৬ সালে রাজধানীর উপকণ্ঠে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার চরকিশোরগঞ্জে ১০টি পরিবারের জমি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজের আয়ত্তে নেন লতিফ। সেখানে গ্লোব শিপইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে জাহাজ মেরামতকারী একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই শিপইয়ার্ডে যাতায়াতের জন্য অসহায় মানুষের ফসলি জমি দখল করে নির্মাণ করেন সড়ক। অবৈধভাবে জমি দখলে নিতে লতিফ তার অনুসারীদের দিয়ে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে একের পর এক মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে কোণঠাসা করেন। চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে আড়াই একর জমির ওপর গড়ে তোলা শিপইয়ার্ড কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৯ একরে দাঁড়ায়। এছাড়া গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসের জন্য ২৩ লাইসেন্সের মধ্যে এমপি লতিফেরও একটি ছিল। তার প্রতিষ্ঠানের নাম জিডি হারবার সার্ভিসেস।

ব্যবসায় সংগঠনে পরিবারতন্ত্র কায়েম : ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সভাপতি হন লতিফ। একই বছর নৌকার প্রার্থী হয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। মূলত ২০১৩ সালের পর চট্টগ্রাম চেম্বারে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। লতিফ নিজেই নির্বাচনের আগে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রার্থী ঠিক করতেন। কেউ প্রতিবাদ করলে পরবর্তী নির্বাচনে কৌশলে বাদ পড়ে যেতেন। এক্ষেত্রে তিনি তার মতের বিরোধীদের দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এমএ লতিফের পরে জাতীয় পার্টির মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম চেম্বার সভাপতি হলেও তিনি এক মেয়াদের বেশি টিকতে পারেননি। পরে লতিফ তার অনুগত ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলমকে চেম্বারের সভাপতি বানান। টানা ১০ বছর মাহবুবুল আলম সভাপতি ছিলেন। তার মাধ্যমে চট্টগ্রামে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ রয়েছে এমএ লতিফের বিরুদ্ধে। মাহবুবুল আলম এফবিসিসিআইর সভাপতি হওয়ার পর চট্টগ্রাম চেম্বারের সর্বশেষ গঠিত বোর্ডে এমএ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজকে সভাপতি এবং অপর ছেলে ওমর মুক্তাদিরকে পরিচালক বানান। এক্ষেত্রে অনেক সিনিয়র ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের ডিঙিয়ে নিজের ছেলেকে চেম্বার সভাপতি করায় ব্যবসায়ী মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই বোর্ডে সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলমের মেয়ে রাইসা মাহবুব সহসভাপতি এবং ছোট ভাই আলমগীর পারভেজ ছিলেন পরিচালক। লতিফের এমন স্বেচ্ছাচারিতা এবং পরিবারতন্ত্রের কারণে প্রায় এক যুগ ধরে ব্যবসায়ীরা শতবর্ষী এই চেম্বারে নেতৃত্বে যাওয়ার আগ্রহ হারান। তার সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কথা বলতে পারেননি।

চেম্বারের অর্থায়নে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মিত হলেও নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে স্পেস বরাদ্দ দিতেন লতিফ। চেম্বার ছিল তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের মতো। চেম্বারের পুরোনো ভবনটিও রেখেছিলেন নিজের দখলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্টল বরাদ্দের নামে প্রতিবছর কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন লতিফ। তার রাজনৈতিক কার্যক্রমও চলত চেম্বারের হলরুমে।

লতিফের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতারাও ছিলেন একাট্টা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমএ লতিফের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিল মহানগর আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে গণসংযোগও করেছিলেন কেউ কেউ। লতিফের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কেন্দ্রে সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চেম্বার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। আন্দোলনের মুখে লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজসহ ২৪ পরিচালক একযোগে পদত্যাগ করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এরশাদ নামে একজনকে গুলির ঘটনায় ১৭ আগস্ট এমএ লতিফকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ৪ আগস্ট নগরীর ডবলমুরিং থানার দেওয়ানহাট এলাকায় এরশাদকে গুলি করা হয়েছিল। এ ঘটনায় তিনি নিজেই এমএ লতিফসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১০০ থেকে ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।


পিএনএস /আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন