পেশাজীবন থেকে ছিটকে পড়া নারীদের ফেরাতে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’, ১৯ জানুয়ারি থেকে আবেদন

  17-01-2025 08:42PM

পিএনএস ডেস্ক: ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর পর চাকরিতে যোগ দেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা নুসরাত জাহান (২৭)। তবে কোনো কিছুই আর আগের মতো ঠিকঠাক চলছিল না। বাড়িতে সন্তানকে দেখভাল করার কেউ নেই, অফিসে দিবাযত্ন কেন্দ্র নেই। এই অবস্থায় এক মাস পর চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। দেড় বছর ধরে তিনি আর চাকরি করছেন না। তবে দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে, এমন একটি অফিসে চাকরি পেলে এখনই কাজে যোগ দিতে চান।

নুসরাতের মতো এমন অনেক নারী রয়েছেন, যাঁরা কোনো না কোনো কারণে পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা আবার কাজে ফিরতে চান। কিন্তু চাকরিজীবনে বিরতি পড়ে যাওয়ায় ফেরাটা সহজ হচ্ছে না। এমন নারীদের কর্মজীবনে ফেরাতে, কাজের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ (কাজে ফিরিয়ে আনার সেতুবন্ধ) নামে উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।

‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মজীবনে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর বিরতিতে থাকা নারীরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। অনলাইনে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ কার্যক্রমে আবেদনের পোর্টালটি ১৯ জানুয়ারি রোববার থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য খোলা থাকবে। এই সময়ের মধ্যে আগ্রহীদের আবেদন করতে হবে।

নুসরাত জাহান বলেন, ‘তিন বছর চাকরি করেছি। চাকরি করার সময় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তো ছিলামই, তবে সবচেয়ে বড় বিষয়, আত্মবিশ্বাস ছিল অনেক।’
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ জরুরি হলেও বাংলাদেশের নারীরা এখনো এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ৫ জানুয়ারি। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কমেছে।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯তম আইসিএলএসের (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) ভিত্তিতে দেশের শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের হার প্রায় ৪৯ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৭৯ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ। এর আগে ২০২২ ও ২০২৩ সালে নারীদের অংশগ্রহণের হার যথাক্রমে ২১ শতাংশ ও প্রায় ২৩ শতাংশ ছিল।

জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শ্রমশক্তির ২৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন। পুরুষ বেকার ১৭ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী বেকার ৮ লাখ ৭০ হাজার। ২০২৩ সালের তুলনায় বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে।

‘আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করেন নুসরাত জাহান। পরে এমবিএ (হিসাববিজ্ঞান) করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নুসরাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর চাকরি করেছি। চাকরি করার সময় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তো ছিলামই, তবে সবচেয়ে বড় বিষয়, আত্মবিশ্বাস ছিল অনেক।’

‘ব্রিজ রিটার্নশিপের’ মেয়াদ শেষে সব অংশগ্রহণকারীকে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সনদ দেওয়া হবে। অংশগ্রহণকারীদের জন্য ব্র্যাক এবং ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
নুসরাত বলেন, ‘এখন আমার আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। একটি সেফটিপিন কিনতে হলেও স্বামীর (ব্যবসায়ী) কাছে চাইতে হয়। সংসারে খরচ বেড়েছে, অথচ আয় কমে গেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।’ তিনি বলেন, এখন তাঁর ছেলের বয়স পৌনে দুই বছর। মানসম্মত দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে, এমন অফিসে চাকরির সন্ধান করছেন। কিন্তু বিরতি পড়ে যাওয়ায় চাকরি পাওয়া সহজ হচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে স্নাতকোত্তর পড়া অবস্থায় ২০১৩ সালে চাকরিতে যোগ দেন জাহিদা হক (৩৫)। সন্তানের জন্ম নেওয়া ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত মায়ের দেখভালের জন্য ২০২১ সালের পর আর চাকরি চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। এর ফাঁকে একবার একটি সংস্থায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ‘মোশন গ্রাফিকস’ না জানায় চাকরিটা হয়নি। পরে তিনি ‘মোশন গ্রাফিকসের’ ওপর দুই মাসের একটি কোর্স করেছেন।

জাহিদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিরতি পড়লে চাকরিতে ফিরতে চাওয়া নারীদের জন্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। একটা মানসম্মত দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকবে এমন অফিস প্রয়োজন, যেখানে আমি মনে করব, আমার সন্তান নিরাপদ। তেমন কোনো অফিসে চাকরির সুযোগ পেলে ফিরতে চাই। কারণ, আমি এখন একধরনের আত্মপরিচয়–সংকটে ভুগি। একই সঙ্গে সন্তানকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিই।’

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক খাতে অংশগ্রহণে নারীদের সমান সুযোগ না থাকা সমাজে নারী-পুরুষের অসমতা বাড়িয়ে তুলছে। গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক জেন্ডার অসমতা প্রতিবেদন ২০২৪-এ বলা হয়েছে, লিঙ্গভিত্তিক বা জেন্ডার সমতা সূচকে গত বছরের চেয়ে বাংলাদেশে ৪০ ধাপ নেমেছে। ৬৮ দশমিক ৯ স্কোর পেয়ে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৯তম অবস্থানে।

অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন—এই চার সূচকে নারী, পুরুষ ও অন্য লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ লাগাতার খারাপ করছে। গত পাঁচ বছরে শ্রমশক্তিতে বৈষম্য আরও বেড়েছে। নারী-পুরুষের আয়ে অসমতা পাঁচ গুণ বেড়েছে।

‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ যেভাবে নারীদের কাজে ফেরাবে
‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ বিষয়ে ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সব বাধা অতিক্রম করে আবারও কাজে ফিরে আসতে প্রস্তুত থাকেন অনেক নারী। কিন্তু একবার কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়লে নতুন করে একটা চাকরি খুঁজে পাওয়া যে কতটা কঠিন, সেটা ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে উদ্যোগটির নকশা করা হয়েছে।

‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ একটি ছয় মাসের কার্যক্রম। যেখানে নির্বাচিত নারী প্রার্থীরা নির্ধারিত হারে বেতন পাবেন। যাঁর যাঁর শিক্ষা ও পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী নির্ধারিত ক্ষেত্রে কাজের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ পাবেন। স্নাতক উত্তীর্ণ নারী পেশাজীবী, যাঁদের কমপক্ষে তিন বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁরা আবেদন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কর্মজীবন থেকে বিরতির সময়কাল হতে হবে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর। যেকোনো বয়সের নারীরা আবেদন করতে পারবেন। তবে পূর্ণকালীন চাকরিতে রয়েছেন, এমন কেউ আবেদন করতে পারবেন না।

অংশগ্রহণকারী নারীরা ব্র্যাকের অভিজ্ঞ পেশাদারদের কাছ থেকে হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি মেন্টরশিপ, পেশা নিয়ে পরামর্শ এবং নেতৃত্ব উন্নয়নের সুযোগ পাবেন। এগুলো তাঁদের কর্মক্ষেত্রে পুনরায় প্রবেশের জন্য বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

অনলাইনে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ কার্যক্রমে আবেদনের পোর্টালটি ১৯ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য খোলা থাকবে। ‘ব্রিজ রিটার্নশিপের’ মেয়াদ শেষে সব অংশগ্রহণকারীকে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সনদ দেওয়া হবে। অংশগ্রহণকারীদের জন্য ব্র্যাক এবং ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

উদ্যোগটি প্রসঙ্গে ব্র্যাকের ‘জনগণ, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ’ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক মৌটুসী কবীর বলেন, ‘ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে অনেক নারী কর্মক্ষেত্র ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। ব্র্যাকের ব্রিজ রিটার্নশিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ওই নারীদের কর্মজীবনে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এই উদ্যোগটি কর্মজীবন থেকে বিরতি নেওয়া নারীদের পেশাজীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।’

এসএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন