মৃত্যুও হার মেনেছে তাদের ভালোবাসার কাছে!

  29-12-2017 04:22PM

পিএনএস ডেস্ক:প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসা এতটাই প্রবল ছিল যে, ভালোবাসার প্রতিদানে শাহজাহান নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বখ্যাত নিদর্শন তাজমহল। যুগে যুগে এই ভালোবাসার জন্য অনেকে জীবনও দিয়েছেন। হাল আমলেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে শাহজাহানের উপমাই সর্বাধিক ব্যবহৃত। এমনই ভালোবাসার অন্যরকম নিদর্শন দেখিয়েছেন জিল ও রায়ান।

কল্পকাহিনী নয়, সত্যিকারের একটি গল্প। ভালোবাসার গল্প। যুদ্ধ জয়ের গল্প। জিল ও রায়ান পৃথিবীর সুখী দম্পত্তিদের অন্যতম। হাসি-খুশি আর প্রেমানন্দে কাটছিল তাদের জীবন। প্রতিদিন রায়ান চেয়ারে বসে পত্রিকা, বই আর ম্যাগাজিন পড়েন। পাশেই শুয়ে থাকেন স্ত্রী জিল। অনেক স্বামী হয়তো স্ত্রীকে গান শুনিয়ে, গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ান। তবে রায়ান ব্যতিক্রম। তিনি বেশিরভাগ সময়ই স্ত্রীকে পত্রিকা-ম্যাগাজিন পড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ান। আবার ভোরের পত্রিকা পড়া শুনিয়ে ঘুম ভাঙান।

প্রতিদিনের মতো ওই দিনও রায়ান পত্রিকা পড়া শুনিয়ে স্ত্রী জিলকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। জিল ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল। ২০০৭ সালের মে মাসের দিনটি ছিল শনিবার। রায়ান অনুভব করলন স্ত্রী জিলকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠাতে হবে। তাই তড়িঘড়ি করে প্রতিদিনের মতো পত্রিকা পড়া শুরু করে রায়ান। তিনি যখন স্ত্রীকে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন, স্ত্রী নিশ্চুপ। শরীর নিস্তেজ! মুখ দিয়ে কোনো স্বর ফুটে না! হাত-পা অবশ! পুরো দেহটাই যেন লেপ্টে গেছে বিছানার সঙ্গে। রায়ান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। কিন্তু সেই আওয়াজ পৌছায় না জিলের কর্ণকোহরে।

রায়ান একসময় উপলব্ধি করে জিলের কিছু একটা হয়েছে। যখন সে বুঝল যে, জিল আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে না তখন সে সিপিআর (হার্ট অ্যাটাক হলে জরুরি চিকিৎসা পদ্ধতি- একটি যন্ত্রের উপর রেখে বুকে চাপ প্রয়োগ করা) পদ্ধতিতে জিলকে বিছানা থেকে ফ্লোরে নামিয়ে আনে। এরপর ওই পদ্ধতিতে তার বুকে চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে জিলের শ্বাস ফিরে।

এরপরই রায়ান ৯১১-এ ফোন করেন। ফোন পেয়ে প্যারামেডিকেল কর্মীরা সেখানে উপস্থিত হন। তারা সেখানে জিলের অবস্থা দেখে ভড়কে যান। পরে দ্রুত থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহুম হার্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর জিলকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে যান। এরই পাশে রায়ান বসে পড়েন প্রার্থনায়। ঈশ্বরের কাছে দু’হাত তুলে চেয়ে যান প্রিয়তমার জীবন।

রায়ান দেখলো তার স্ত্রী জিলের শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য তাকে একটি বিশেষ জামা পড়ানো হয়েছে। তাকে পড়ানো হলো লাইফ সাপোর্ট যন্ত্র। এটা এজন্য পড়ানো হয়েছিল যাতে, কোনোভাবেই অক্সিজেনের অভাবে জিলের মস্তিস্কের কোনো ক্ষতি না হয়। স্বামী রায়ানের প্রার্থনা আর সেবায় জিল প্রাণে বেঁচে গেলেও সারাজীবনের জন্য কোমাতে চলে যান তিনি। কোনোদিনই তিনি কোমা থেকে ফিরবেন না বলে ডাক্তাররা ধারণা করেছিল। তবে রায়ানকে তারা সেটি বুঝতে দেননি। তারা রায়ানকে জানায় যথাযথ সেবা পেলে জিল আবারও সুস্থ হয়ে উঠবে।

এতে রায়ান দেখলো, তার জীবনের সব বাতিগুলো একের পর এক নিভে যাচ্ছে। তার অতীতের সব স্মৃতি যেন একপলকে চোখের সামনে এসে দুল খেয়ে যাচ্ছে। একদিকে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, অতীতের সুখকর-রোমাঞ্চকর জীবন। অন্যদিকে স্ত্রী কোমায়! তিনি আর কখনো কোমা থেকে ওঠবেন না। আর কখনো জেগে ওঠবে না। এতে তার হৃদয়জুড়ে হাহাকারের এক সাইক্লোন বয়ে যায়।

কোমা থেকে ওঠার পর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন রায়ানকোমা থেকে ওঠার পর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন রায়ানদু’চোখে জল টলমল করছে। এরইমাঝে রায়ান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত স্ত্রীর পাশেই থাকবেন। তাই হাসপাতাল-ই হল তার ঠিকানা। একদিকে স্ত্রীর সেবাযত্ন, অন্যদিকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল পাঠ। এ দুয়ে মিলে কাটছিল তার জীবন। এভাবেই চলতে থাকল বেশ ক’দিন। কিন্তু জিলের অবস্থা অপরিবর্তিত-ই রয়ে গেল। ডাক্তাররা রায়ানকে জিলের প্রকৃত অবস্থা না বললেও, এটা বলেছিল জিলের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ রয়ে গেছে। তবে রায়ানের এটা বুঝতে বাকি ছিলো না যে, জিল হয়তো বেঁচে থাকবে, তবে সারাজীবন সে একজন পুতুল হিসেবেই বেঁচে থাকবে। ডাক্তারের কাছ থেকে এটা শোনার পরও রায়ান জিলের ভাগ্য মেনে নিতে পারেনি। তাই সে বেছে নেয় প্রার্থনা আর সেবাকে।

রায়ান বেঁছে নেয় লেখনিকে। বলা হয়ে থাকে, আঁকাআঁকি করলে, লেখালেখি করলে মনের দুঃখ কিছুটা হলেও লাগব হয়। তাই লেখালেখি শুরু করেন। রায়ান লিখেন, ‘সে আমার আজীবনের সঙ্গী এবং আমার স্ত্রী, পৃথিবীতে আমার সবকিছু। আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি হারিয়ে যাব। আমি কখনো আশা ছাড়বো না। আমি কখনো তাকে ছেড়ে যাব না।’

প্রতিদিন আমি যখন জেগে ওঠতাম, তখন ডাক্তারের আগমন আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো। ডাক্তাররা আমাকে প্রতিদিন বলতো, জিলের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। একদিন ডাক্তাররা এসে আমাকে তার পরিস্থিতির কথা বলতে থাকেন। পাশেই ছিলেন জিলের মা-বাবা। শেষে জিলের মা-বাবার আদেশে জীবনের সবেচেয়ে কঠিনতম সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছিল সেদিন আমার। আমি সেদিন কি সিদ্ধান্ত নিব বুঝতে পারছিলাম না। তবে মা-বাবার কথামতো সিদ্ধান্ত নিলাম। জিল বেঁচে থাকবে না মরে যাবে সে বিষয়ে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

অবশেষে ডাক্তারদের জানানো হলো, জিল আর হাসপাতালের বেডে থাকতে চান না। ততদিনে কেটে গেলে কয়েক মাস। তবে হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছিল না। অবশেষে রায়ান শরণাপন্ন হন আদালতের। অবশেষে আদালতের রায় রায়ানের পক্ষে যায়। ২০০৭ সালের জুনের কোনো একদিনে তার স্ত্রীর মুখ থেকে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।

ডাক্তাররা বলেছিল লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার পরই জিলের শারীরিক নড়াচড়া হবে। আর এটা হবে জীবনের শেষ নড়াচড়া। এটাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত বলা হয়। রায়ান এবং জিলের পরিবার জিলকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর জুনের ওই দিনটিতে সন্ধ্যা ৬টার দিকে জিলকে বাঁচিয়ে রাখা লাইফ সাপোর্ট খুলে নেন ডাক্তাররা। তবে সে খুব দ্রুতই মরে যাননি। এরপর কাতুর চোখে রায়ান জিলকে এক নজর দেখলো। যখন ওই কক্ষটিতে একটি আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হল, তখন রায়ান ওই কক্ষটি ত্যাগ করলো। আমি ক্ষণিকের জন্য খুব দুর্বল হয়ে পড়লাম, যোগ করেন তিনি। রায়ান ভাবলেন, এটাই বুঝি আরেক জীবনের শুরু।

ক্ষণিক পরেই ঘটলো আরেক কাণ্ড! রায়ানকে এক নার্স ডেকে বললো জিল কথা বলছে। রায়ান এই ঘটনাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু তিনি ওই কক্ষে ফিরে এলেন। এরপরই ঘটলো আরেক কাণ্ড! জিল পলকহীন চোখে কাতুর কণ্ঠে রায়ানকে বললো, প্লিজ গেট মি আউট অব হেয়ার (আমাকে এখান থেকে বাইরে নিয়ে চল)।

এটা বলেই থেমে যাননি জিল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে, জিল প্রথমেই যেতে চান প্রিয় রেস্টুরেন্ট টেডস এবং মেল্টিং পটে। ততক্ষণে স্বামী রায়ানের মুখে পৃথিবী জয় করা হাসি। রায়ান নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এরপর রায়ান জিলকে মোবাইল নাম্বার, তাদের কুকুর ও বিড়ালের নাম জিজ্ঞেস করেন। প্রতিটির উত্তর-ই জিল সুন্দর ও গোছালোভাবে দিয়েছিল। রায়ান ততক্ষণে বুঝে গেছে জিলের এই যাত্রা, জীবনের শেষ যাত্রা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে।

জিল কোমা থেকে সেরে ওঠল। ঈশ্বরের অলৌকিক কৃপায় তিনি বেঁচে গেলেন। এরপর তাকে নেওয়া হয় এক হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। সেখানে তার হার্টের সফল অপারেশন করা হয়। এরপর জিল ফিরে আসে। তবে কোমায় থাকার কোন কিছুই মনে নেই তার। ডাক্তাররা বলতি পারছেন না, জিল কী কারণে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। দুয়েকজন ডাক্তার বলেছে, এটা চিকিৎসা বিদ্যারও অজানা।

পরষ্পরকে ছাড়া একটি মিনিটও একা কাটান না। যেখানেই যান, পরষ্পরকে সঙ্গে নিয়ে যান।পরষ্পরকে ছাড়া একটি মিনিটও একা কাটান না। যেখানেই যান, পরষ্পরকে সঙ্গে নিয়ে যান।এরপর জিলকে সুস্থ করে তুলতে রায়ান দিন-রাত তার সেবা করতে থাকেন। জিল আজও বিশ্বাস করেন, রায়ানের ওই দিনের সিদ্ধান্তের কারণেই আজ তিনি বেঁচে গেছেন। আমি ওই জীবনের মতো বাঁচতে চাইনি। আমি একটি সবজির মতো বাঁচতে চাই না। জিল এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। তারা পরষ্পরকে ছাড়া একটি মিনিটও একা কাটান না। যেখানেই যান, পরষ্পরকে সঙ্গে নিয়ে যান। ওই দম্পত্তি এখন প্রায়ই জিলের সেই বিখ্যাত টেডস আর মেলটিং পট রেস্টুরেন্টে যান, ঘুরেন শহরজুড়ে। হাসিতে হাসিতে মেতে ওঠেন আনন্দে। এটাই তো জীবন। জীবন এমনই।

সূত্র : লাইফ ডেইলি/আরটিভি

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন