যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে লাভ হবে বাংলাদেশের?

  11-02-2025 08:41PM

পিএনএস ডেস্ক: সব ধরনের চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত দশ শতাংশ শুল্ক আরোপের জবাবে বেশ কিছু মার্কিন পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ কার্যকর করেছে চীন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা আরও জোরদার হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করলেও বিশ্ব বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখলে আরও অনেক দেশ এতে জড়িয়ে পড়তে পারে।

এসবের ফলে ধীর হয়ে যেতে পারে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ট্রাম্প ইতোমধ্যে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন এবং এর ফলে কানাডার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

এর আগে, তিনি মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেও পরে দেশ দু’টির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তা স্থগিত করেন। কিন্তু একই সঙ্গে চীনের সব ধরনের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত দশ শতাংশ শুল্ক বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে আসেননি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, গত ৪ ফেব্রুয়ারি সব চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি কার্যকরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেইজিংও মার্কিন পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা আজ (মঙ্গলবার) কার্যকর হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বাণিজ্য পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদী হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিকে ধীর করবে এবং এর ফলে বৈশ্বিক কর্মসংস্থানে ও বাংলাদেশের মতো স্বল্প মাত্রায় রপ্তানি করে এমন দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষক ড. সুবর্ণ বড়ুয়া বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করেছে চীনা রপ্তানির ওপর এবং সেটি যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির জন্য প্রযোজ্য হলেও বৈশ্বিক বাণিজ্যেই এর প্রভাব পড়বে।

• বাংলাদেশ কি লাভবান হবে?
ব্যবসায়ী ফজলুল হকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধের কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা কোন পর্যন্ত যায় সেটি সম্পর্কে এখনই ধারণা করা কঠিন। তবে আপাত দৃষ্টিতে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারলে বাংলাদেশ শুধু তৈরি পোশাক খাতে কিছুটা হলেও লাভবান হওয়ার সুযোগ পেতে পারে।

‘‘অনিশ্চয়তার জায়গাটি এখনও পরিষ্কার না। সামনে বোঝা যাবে। তৈরি পোশাক খাতে চীন থেকে কিছু অর্ডার ডাইভার্ট হতে পারে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, ব্যাংক সহায়তার ক্ষেত্রে চলমান সমস্যার সমাধান করা গেলে তার কিছুটা হলেও সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশ করতে পারে,’’ বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চীন ও ভিয়েতনাম থেকেই প্রায় ৪০ শতাংশ তৈরি পোশাক আমদানি করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে করে মাত্র ৯ শতাংশ। তবে সেদেশে রপ্তানি করা শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত ও ইন্দোনেশিয়াও।

বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো চলতি বছরের জানুয়ারিতে বলেছিল, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে তৈরি পোশাক; যার মূল্য সাত দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার এবং এটি দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের চীনা পণ্যে দশ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় চীনের তৈরি পোশাক খাতের ওপরেও এর প্রভাব পড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ এনে দিতে পারে।

‘‘২০২৩ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ বিলিয়ন ডলারের অ্যাপারেলস রপ্তানি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ঢালাওভাবে চীনের সব পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে। এটি চীনের পোশাক খাতে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে তার সামান্য অংশ অর্ডারও নিজের দিকে আনতে পারলে বিরাট লাভবান হওয়া যাবে,’’ বলেন ড. সুবর্ণ বড়ুয়া।

তিনি বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষে এটি সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ ভিয়েতনামের মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আছে সেখানে। বাংলাদেশের উচিত হবে সামান্য সুযোগ থাকলেও সেটি নিয়ে কাজ করা এবং এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়ানো।

সাধারণত এক দেশ অন্য দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করলে অন্যদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়, কারণ তখন বিনিয়োগকারীরা বিকল্প উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। আবার যারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে তারা ব্যবসার স্বার্থে তখন বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এ দুটি বিষয় বিবেচনা করলে বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। তবে এর উল্টো দিকও আছে।

‘‘কারণ বড় দেশগুলোর পাল্টাপাল্টি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে তাদের নিজেদের বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে এবং এর ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। সেটি হলে কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোর রপ্তানিতেও প্রভাব পড়বে,’’ বলেন তিনি।

তবে তার মতে, চীনা রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ করায় স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য সুবিধার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে কতটা সক্ষম সেই প্রশ্ন আছে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘আমাদের আর্থিক খাত, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট এবং রিজার্ভের যে পরিস্থিতি তাতে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তাই সুযোগ আসলেও নেওয়ার সক্ষমতা নেই। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন ও চীনের সংরক্ষণবাদ নীতি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না। কারণ এতে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’’

অর্থাৎ সব মিলিয়ে চীনা পণ্যে মার্কিন শুল্কের কারণে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য কিছু লাভ এনে দিতে পারে বলে মনে করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে এই বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।

এর আগে, ২০১৮ সালেও যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করলে চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এতে দুই পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

সেবার চীনা পণ্যের ওপর প্রায় তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের শুল্ক আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে চীনও ৫৪৫টি মার্কিন পণ্যের ওপর একই রকম শুল্ক আরোপ করে। তখন চীনই বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছিল। এর ফলে তখন পশ্চিমা দেশগুলোতে জিনস, মোবাইল ফোন, ছাতা, এমনকি যৌন সামগ্রীর দামও বেড়ে যায়।

কিন্তু সেবার চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্টো বাংলাদেশের সামগ্রিক পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা ছিল ২০১৯-২০ সালে। পরে ২০২০ সালে বাণিজ্য যুদ্ধ অবসানে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ওই দুই বছরে উভয় দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমেছিল।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাণিজ্য যুদ্ধে যেহেতু পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তাই শেষ পর্যন্ত এবারেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষই, যারা পণ্য কেনেন। আর দাম বাড়লে ক্রেতারা কম কিনবেন, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি কমবে। তবে এর প্রভাব কতটা ব্যাপক হয় এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা আরও বেড়ে যায় কি-না সেই আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এসএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন