যেভাবে ধরা পড়ল চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ

  16-03-2025 09:00PM

পিএনএস ডেস্ক: চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ওরফে বুড়ির নাতি। কথায় কথায় গুলি ছোড়ার কারণে আলোচিত তিনি। কোনো ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তার নজরে পড়লে আর রেহাই মিলত না। যেকোনোভাবে চাপ প্রয়োগ করে আদায় করতেন মোটা অঙ্কের চাঁদা। নগরের বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও খুলশী এবং জেলার হাটহাজারী-রাউজান উপজেলার কয়েক লাখ বাসিন্দা তার চাঁদাবাজিতে ছিলেন অতিষ্ঠ। এসব এলাকায় নতুন কোনো বড় ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করলেই সাজ্জাদকে দিতে হতো নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাজ্জাদ। বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের এক নেতার প্রশ্রয়ে হয়ে ওঠেন অপরাধ জগতের মূর্তিমান আতঙ্ক। এসময়ের মধ্যে তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটান সাজ্জাদ। তাকে ধরতে কোনো কৌশলই কাজ দিচ্ছিল না চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি)।

গত ৫ ডিসেম্বর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার অক্সিজেন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। তখন উল্টো পুলিশকে গুলি করে পালিয়ে যান সাজ্জাদ। নাকানিচুবানি খাওয়ানো এ সন্ত্রাসীকে নানারকম ফাঁদ পেতে শনিবার (১৫ মার্চ) দিবাগত রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স থেকে গ্রেপ্তার করে সিএমপির একটি টিম।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। অন্তত চার মাস ধরে তাকে গ্রেপ্তারে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কৌশলই কাজে আসছিল না। আবার মোবাইলে কোনো সিম সংযোগ না থাকায় তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে তাকে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তবে গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে সাজ্জাদের স্ত্রীর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে একটি কার দেখা যায়।

এ সূত্র ধরে এগোতে থাকে পুলিশ। প্রথমে বিআরটিএ থেকে ওই গাড়ির মালিককে শনাক্ত করা হয়। গাড়ির মালিকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। চালক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নাকে নিয়ে তিনি অক্সিজেন মোড়ের একটি বাসা থেকে রাউজানের কদলপুর এলাকায় গিয়েছিলেন। চালকের দেওয়া বক্তব্যের সূত্র ধরে অক্সিজেন মোড়ের ওই বাসার সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করা হয়। সেখানে সাজ্জাদের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়। পরে ৫ ডিসেম্বর বাসাটিতে অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু ওইদিন উল্টো পুলিশকে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যান সাজ্জাদ। সেদিন তার ছোড়া গুলিতে কয়েকজন আহত হন।

ঘটনার দিন এক অভিযানে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রথমে সাজ্জাদ পুলিশের সোর্সকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে তিনি আহত হলে উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ফাঁকে সাজ্জাদ ছয় তলা ভবনের ছাদে উঠে যান। ছাদের দরজায় তালাটি ভেঙে ফেলেন গুলি করে। এরপর পার্শ্ববর্তী একটি পাঁচ তলা ভবনে লাফ দিয়ে চলে যান। সেখান থেকে আরেকটি ভবনে লাফ দেন। ওই ভবনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে কেয়ারটেকারকে গুলি করে পালিয়ে যান সাজ্জাদ।

সিএমপির ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওই ঘটনার পর সাজ্জাদ একেবারে গা-ঢাকা দেন। সিমযুক্ত মোবাইল ব্যবহার না করে শুধু যোগাযোগের জন্য বিশেষায়িত অ্যাপস ব্যবহার করতেন তিনি। এটি দিয়ে স্ত্রী ও সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তবে সাজ্জাদকে ধরতে স্ত্রীর ওপর নজরদারি অব্যাহত রাখে পুলিশ। স্ত্রীর গতিবিধির মাধ্যমে সাজ্জাদের ঢাকায় বাসা নেওয়ার তথ্য পায় পুলিশ।

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সপ্তাহখানেক আগে থেকে পুলিশের সোর্স ঢাকায় অবস্থান নেন। সবশেষ তামান্না তার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে যান। সঙ্গে ছিলেন সাজ্জাদও। সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেয় সিএমপির টিম। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে শপিং কমপ্লেক্সে সাজ্জাদ ও তার স্ত্রীর গতিবিধির ওপর নজরদারি করা হয়। একপর্যায়ে সাজ্জাদকে আটক করে পুলিশ। প্রথমে তাকে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। পরে তাকে তেজগাঁও থানায় নিয়ে পুলিশ স্কটের মাধ্যমে চট্টগ্রামে আনা হয়।

রোববার (১৬ মার্চ) তাকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ। তিনি বলেন, গত আগস্টে অক্সিজেন এলাকায় জোড়া খুন এবং পরে চান্দগাঁও এলাকায় প্রকাশ্যে একজনকে গুলি করে হত্যা করেছে সাজ্জাদ। পাশাপাশি প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি, গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধী কার্যক্রম করত। দুবাই প্রবাসী বড় সাজ্জাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে সে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন ধরনের হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করত।

গ্রেপ্তারের পরপরই সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্নার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার জামাই গতকাল রাতে অ্যারেস্ট হইছে। এটা নিয়ে এত হাই হুল্লাস (হা হুতাশ) করার কিছু নাই। মামলা যখন আছে, অ্যারেস্ট হবে। এগুলো নিয়ে এত টেনশন করা, দুঃখ প্রকাশ করা, কান্নাকাটি করার কিছু নাই। আপনারা যারা ভাবতেছেন আমার জামাই অ্যারেস্ট হইছে আর কোনোদিন বের হতে পারবে না, ওদের জন্য এক বালতি সমবেদনা। আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি, বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছেড়ে আমার জামাইকে নিয়ে আসব। আমার জামাই বীরের বেশে চলে আসবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন যারা এই ঘটনা ঘটাইছে, তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না; মাথায় রাইখো। এতদিন আমরা পলাতক ছিলাম, এখন তোমাদের পলাতক থাকার পালা। আমার জামাই আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমার কাছে আসবে। তখন খেলা শুরু হবে। খেলা মাত্র শুরু করছো তোমরা, শেষ করব আমরা। আমার জামাই সাজ্জাদের যারা সাপোর্টার আছো সবাই দোয়া করবা, যাতে ১০-১২ দিনের মধ্যে জামিন করাই ফেলতে পারি। ঠিক আছে, ধন্যবাদ।’

বায়েজিদ বোস্তামী থানা সংলগ্ন হাটহাজারীর শিকারপুরের মো. জামালের ছেলে সাজ্জাদ ‘বুড়ির নাতি’ নামে পরিচিত ছিলেন। গত ২৮ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) হুমকি দিয়েছিলেন সাজ্জাদ। এরপর ৩০ জানুয়ারি সাজ্জাদকে ধরতে তথ্যদানকারী কিংবা সহায়তাকারীকে নগদ অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।

অপরাধজগতে পা রেখে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাজ্জাদ। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের এক তরুণ নেতার আশ্রয়ে চলে যান সাজ্জাদ। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অনেক অভিযোগ আছে। হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১০টি মামলা রয়েছে তার নামে। গত বছরের ১৭ জুলাই চান্দগাঁও থানা-পুলিশ অস্ত্রসহ সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করে। পরের মাসেই তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।

জানা গেছে, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে নগরের চান্দগাঁও থানার অদূরপাড়া জাগরনী সংঘ ক্লাব সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে মাইক্রোবাস থেকে নেমে স্থানীয় ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন তাহসীনকে (২৭) গুলি করে হত্যা করে সাজ্জাদ বাহিনী। তারও আগে ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টার দিকে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় শটগান হাতে সাজ্জাদ হোসেনসহ আরও দুজন গুলি করতে করতে একটি নির্মাণাধীন ভবনে প্রবেশ করেন। এরপর ওই ভবন মালিকের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।

এ ছাড়া গত বছরের ২৯ আগস্ট নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে মাসুদ কায়সার (৩২) ও মোহাম্মদ আনিস (৩৮) নামে দুজনকে হত্যা করা হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে দুপক্ষের দ্বন্দ্বের জেরেই এ খুন হয়। চাঞ্চল্যকর এই ডাবল মার্ডারের ঘটনার দুই মামলায় সাজ্জাদ ও তার সহযোগীদের আসামি করা হয়।

এসএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন